পুজোর এক মাসে আগে থেকেই শুরু হয়ে যেতো নাটকের রিহার্সাল, স্যুভেনিরের খুচরো বিজ্ঞাপনই তখন ভরসা

ফিচার রবিছুটি
সেই সময়ের পুজো। বিশ্বায়ন-পূর্ববর্তী সময়ের পুজো। আশির দশকের পুজো। এক অলীক কাল্পনিক সংলাপে প্রাবন্ধিক সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়।

বাঙালির পুজো তখনও কর্পোরেট-রূপ ধারণ করেনি। ‘দাদার কীর্তি’ ছবিতে মহুয়া রায়চৌধুরী।

শেয়ার করুন...
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

–টুবাই আর বুবাই। দুই বন্ধু।

–দূর, তা আবার হয় নাকি! এরা তো নিশ্চয়ই দুই ভাই। আচ্ছা, বেশ, নিজের ভাই না হোক, তুতোভাই তো বটে! না, তাও নয়? শুধু বন্ধু? পাড়াতুতো? তবে কি নামের মিল দেখে বন্ধুত্ব হয়েছিল নাকি?

আরও পড়ুন:  রামায়ণ-মহাভারতের সময়কাল নিয়ে রয়েছে বিস্তর বিতর্ক, বিজ্ঞান এক কথা বলে, বিশ্বাস আর এক কথা

–তা বলতে পারব না! এটুকু জানি দুজনের ভারি ভাব ছিল। নামের মিল তো ছিলই তবে তার থেকে বেশি বোধহয় ছিল মনের মিল।

–বেশ, আর কী মিল ছিল দুজনের?

–দুজনের বেড়ে ওঠা, বড় হয়ে ওঠা এই কলকাতাতেই। আর তা আশির দশকের স্কুলবেলা।

–তা, এই পুজোর সময়ে ওদের গল্প বলতে বসেছ কেন?

–কারণ, পুজোর সঙ্গেই যে ওদের অনেক গল্প জড়িয়ে।

–এই ‘হিয়া টুপ টাপ জিয়া নস্টাল’-এর কোনও মানে আছে? ওসব সিনেমার গানেই হয়। বাস্তবে অতীতের খারাপ ব্যাপার ভুললে চলবে কেন? আশির দশকের পুজো নিয়ে আদিখ্যেতা করার আগে একটু মনে করার চেষ্টা করো কিরকম কান ফাটানো মাইক বাজত ওই সময়ের কলকাতার পুজোয়! আর কী সব গান বাজত চোঙা, লাউড স্পিকারে; হয় বোম্বের সিনেমার জনপ্রিয় হিন্দি গান অথবা একইরকম চটুল বাংলা বা বলা ভাল হিংলা গান! আর তার ওপর চাঁদার জুলুম ভুলে গেলে নাকি! খুব তো বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে কথা বলছো; ‘স্পন্সরশিপ নেওয়া পুজো পুঁজিবাদের প্রতীক’ জাতীয় কথা বলছো, কিন্তু একবারও ভেবে দেখেছো কি আশির দশকে স্যুভেনিরে দু’চারটে খুচরো বিজ্ঞাপন পাওয়া পুজোর উদ্যোক্তাদের চাঁদা তোলা ছাড়া আর অন্য কোনও উপায় ছিল না! আর ‘থিম পুজোতে আন্তরিকতার প্রচণ্ড অভাব’ জাতীয় যে কথা বলছো, ভেবে দেখো শহর-জোড়া এরকম ইন্সটলেশন আর্ট থিম পুজো ছাড়া কি সম্ভব হত? আর পুজোর পুরস্কার ছাড়া এরকম শৈল্পিক থিম পুজোর আয়োজন কি আদৌ হতে পারত?

–বেশ, মেনে নিলাম। এসব কথায় যুক্তি আছে। সবটা সত্যিই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু এসব তত্ত্বকথা থাক না, আমাদের তো গল্প হচ্ছিল  টুবাই আর বুবাই – এই দুই বন্ধুকে নিয়ে।

–তারা তো আশির দশকে স্কুলবেলা পার করেছে। তা তাদের আবার ওই গাঁক গাঁক মাইক আর চাঁদার জুলুম নিয়ে অত নস্টালজিয়া কীসের?

–না, আসলে তারা আশির দশকের কলকাতায় পুজো কাটিয়েছে ঠিকই তবে তারা বড় হয়েছে এক নতুন গড়ে ওঠা সরকারি আবাসনে। সে পুজোয় প্রাণে গান ছিল। পুজোর মাসখানেক কি তারও আগে থেকে শুরু হত পুজোর নাটকের রিহার্সাল, একইসঙ্গে চলত গীতিনাট্য- নৃত্যনাট্যের প্রস্তুতি। কোনওবার ‘ঋতুরঙ্গ’ কোনওবার ‘তাসের দেশ’…

–বেশ, সে তো তাদের পাড়ার পুজোর গল্প। সেখানে টুবাই-বুবাই দুই বন্ধু কোথায়?

–বা রে, এই পুজোর আগের প্রস্তুতিতে তো তারা জুড়ে ছিল। তাসের দেশে তারা তো হাজির ছিল।

–তারা, নাচত বুঝি? তারা কি রাজপুত্র আর সদাগরপুত্র হয়েছিল?

–না, তারা নাচত না। আবার তারা রাজপুত্র আর সদাগরপুত্র হয়েছিল, এটাও ঠিক।

–সে আবার কী!

–আসলে তাসের দেশ মঞ্চস্থ হওয়ার সময়ে এক একটা বড় চরিত্রে থাকত তিনজন করে; একজন গানে, একজন নাচে আর একজন কথায়। তা সেভাবেই টুবাই-বুবাই দুই বন্ধু রাজপুত্র আর সদাগরপুত্র হয়েছিল। তাদের স্মৃতিতে তাই ধরা আছে ‘চলো নিয়ম মতে, দূরে তাকিও নাকো, ঘাড় বাঁকিয়ো নাকো’র বিপরীতে ‘আমরা নূতন যৌবনেরই দূত’ বা ‘এলেম নূতন দেশে’!

–তাহলে, সত্যিই তো এক নতুন দেশে এসেছিল তারা।

–সত্যিই তাই। এই কুড়ি কুড়ির উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে শিশুদের সব পেয়েছির দেশের সময়কালে সত্যিই তাদের বড্ড মনে হয় তাসের দেশ-এর রাণিমার কথা; “বুঝেছি বাছা আসলে তোমার অভাবটা অভাবেরই অভাব। পাওয়া জিনিসে তোমার বিতৃষ্ণা জন্মেছে। তুমি চাইতে চাও, আজ  পর্যন্ত সে সুযোগ তোমার ঘটে নি।” একটা বাচ্চা এত কিছু পেয়ে চলেছে যে তার কোনও জিনিসকে যত্ন করার অভ্যাসটাই গড়ে উঠছে না। আর মা-বাবা সময় না দেওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে জিনিস দিয়ে যাচ্ছে, দিয়েই চলেছে!

–পুজোর গল্প বলো। তাসের দেশ বাদ দিয়ে আর কী করেছিল দুই বন্ধু?

–ওরা সুকুমার রায়ের ‘ঝালাপালা’ করেছিল। সত্যি সত্যিই ‘সখের প্রাণ, গড়ের মাঠ’! আরও অনেক কিছু করেছিল। এত বছর পরে সে-সব কি আর মনে আছে নাকি! হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে।  তখন আবাসনের পুজোতে বসে আঁকো প্রতিযোগিতা হত, আবৃত্তি প্রতিযোগিতা হত। একজন কিছুই পারত না; আর একজন দারুণ আবৃত্তি করত। তা যেত কিন্তু দু’জনেই। তারপর একজন যখন চমৎকার আবৃত্তি করে পুরস্কার পেত তখন দুজনে একসঙ্গে আনন্দ করতে-করতে ফিরত। আর সেই পুরস্কারের বই প্রথম পড়ত পুরস্কার না-পাওয়া বন্ধু। এভাবেই তার কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয়। বইটার নামও স্পষ্ট মনে আছে; ‘সাদা পৃষ্ঠা তোমার সঙ্গে’। সন্তু আর কাকাবাবুর লেখক তাহলে কবিও?

–বারে, পাড়ার পুজোয় সব কিছু কি মঞ্চে হত নাকি?

–মঞ্চের ওপরে নয়, মঞ্চের তলায়ও অনেক কিছু হত বৈকি! মঞ্চের অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে তারা বন্দুক দিয়ে ক্যাপ ফাটাত আর পাড়ার এক জ্যেঠু মাইকে বলতেন, ‘বাচ্চারা কটকটি ফাটিও না’।

–দূর, শুধু অনুষ্ঠান আর মঞ্চ! আরে বাবা, তাদের ছোটবেলায় মিঠে খুনসুটি, পাড়াতুতো প্রেম – এসব কী হত না!

–হ’ত বৈকি! এই পুজোর আগের রিহার্সালে অনুরাগ তৈরি হত বৈকি! তবে বলা আর হয়ে উঠত না। পুজোর চার-পাঁচ দিনও শুধু ওই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা থাকত। হয়তো অষ্টমীর দিন শাড়িপরিহিতা ‘তাকে’ অঞ্জলির ফুল দিতে গিয়ে আঙুলের একটুকু ছোঁওয়া লাগা। কিশোরকুমারের গলায় বেজে উঠত, ‘আমার পূজার ফুল…’! বিপদও কম ছিল না। পাড়ার দিদি ঠিকই টের পেয়ে যেত। নিজের বোনই যে সেই গানের দলে রয়েছে। সে যদি বাড়ি গিয়ে বলে, ‘মা, জানো তো…’!  আর মনে পড়ে বিসর্জনের শোভাযাত্রা। পুরো আবাসন পরিক্রমা করবে ঠাকুর। একটা লরিতে দুর্গা আর তার পেছনের লরিতে চার ছেলেমেয়ে। দুর্গামায়ের মুখে সন্দেশ ঠাসা আর চোখে কি একটু জল? তার চোখের জলটা দেখতে পায়নি তো কেউ? দেখলে তো বলবে, ‘এ বাবা, ছেলেরা আবার কাঁদে নাকি?’ আর যদি বুঝে যায়, এই চোখের জল কার জন্য! সে-ই কি সত্যি জানে যে এই জল কার জন্য? দুর্গা চলে যাওয়ার জন্য? নাকি ‘তার’ জন্য; ‘সেই মেয়েটির কাছে, সন্ধ্যাতারা আছে’; নাকি এবছরের মত উৎসব শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য?

–ব্যাস, কাঁদতে কাঁদতে উৎসব শেষ?

–ভারি বেরসিক তো! নরম মনের ছেলেগুলোর মন কেমনটা বুঝলে না! বেশ, অন্য কান্নার কথাটা বলি। ঠাকুরের দুটো লরি যখন আবাসন পরিক্রমার শেষে গঙ্গার দিকে রওনা হত তখন দুই বন্ধু মিলে দুটো এগ রোল কিনে খেতে খেতে আসত। আর তখন ঝাল কাঁচালঙ্কা চিবিয়ে ফেলে চোখে জল এসে যেত।

–সত্যিই আসত নাকি, এ-ও সেই আগের চোখের জলটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা?

–জানি না, যাও। শুধু এটা বলি, তারপরে খাওয়া হত দুটো কোল্ড ড্রিঙ্ক; তখনও কোক-পেপসি এদেশে আসে নি। তখন ছিল গোল্ড স্পট, থামস আপ আর লিমকা।

–টুবাই আর বুবাই দুই বন্ধু কি পাড়া থেকে বেরোত না মোটে? পাড়ার পুজোতেই পুজোটা কাটিয়ে দিত?

–একরকম তাই। অষ্টমীর দুপুরে পাড়ার প্যান্ডেলে জোর সন্দেশ খাওয়া হত। আসলে অষ্টমীতেই তো সব চেয়ে বেশি পুজোর ডালা আসত। সেখান থেকে একটা একটা করে সন্দেশ তুলে সে-সব মেখে তৈরি হত সন্দেশের তাল। আর তা থেকে ভাগ পেত প্যান্ডেলে বসে থাকা ছোটর দল।  আর, নবমীর দুপুরে পাড়ায় দুপুরের খাওয়া হত বেঞ্চ পেতে। তার ওপরে লম্বা কাগজ পেতে দেওয়া হত। আর চেয়ার হত কাঠ বা প্লাইয়ের মোড়া চেয়ার। খাবারের মেনু খিচুড়ি-লাবড়া-বেগুনি-পাঁপড়-চাটনি আর শেষপাতে একটা লাড্ডু। তাই অমৃত মনে হত। ১৯৮৫ থেকে রং কোম্পানির শারদ সম্মান দেওয়া শুরু; বিজ্ঞাপনের ভাষায় ‘শুদ্ধ শুচি, সুস্থ রুচি’। তা সেই সম্মানের ফল বেরোত নবমীর দুপুরে। দুই বন্ধু নবমীর পাড়ার ভোজ খেয়ে ছুটে যেত এক বড় রাস্তার মোড়ে। এখন এই মুঠো ফোনের ইন্টারনেটের যুগে সে-কথা শুনলে হাসি পাবে। সেই বড় রাস্তার মোড়ে এক হোর্ডিংয়ে ফল বেরোত। আর সেই ফল দেখে সেই পুরস্কৃত ঠাকুর দেখার জন্য তাদের যাত্রা শুরু হত। সবটাই বাসে করে আর অনেকটা হাঁটা। কলকাতা চেনাও কি হয়ে যেত?  একবার, কসবার রেল লাইন পার হয়ে একটা বাজার কমিটির পুজোয় শুধু কাগজ কেটে আর ভাঁজ করে করা অপূর্ব শিল্প দেখে মুগ্ধ হয়েছিল দুই বন্ধু। এটাও বলে রাখা যাক যে তখনও এল জি বি টি র কথা কলকাতা সেভাবে শোনে নি। কাজেই তাদের সেই বন্ধুত্বকে কেউ অন্য চোখে দেখে নি।

–তাই?

— হ্যাঁ। এবার শেষটুকু বলি। শেষটা নব্বইয়ের শেষদিককার। এক বন্ধু প্রেমে পড়েছে। প্রেমিকার একান্নবর্তী বাড়িতে দুর্গাপুজো। কাছেই প্রেমিকার নিজেদের অণু পরিবার। যাইহোক, ছেড়ে আসা একান্নবর্তী বাড়িতে পুজোর নিমন্ত্রণ। একা যায় কী করে! সঙ্গী সেই ছোটবেলার বন্ধু। প্রথমে প্রেমিকার নিজের বাড়ি। ছাদে বসে গল্প।  প্রেমিকার বাবাকে ব্যস্ত রাখছে বন্ধু। আর সেই ফাঁকে প্রেমিকার সঙ্গে দু’চার কথা। প্রেম লুকোন ছিল এমনটা নয়। কাজেই এরপরে পুজোর বাড়ি। সেটাও ছিল এক নবমীর রাত। লোকাল ট্রেনে করে শহরতলির এক পুজো বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে দু বন্ধুর কি একটু মন খারাপ?  তা কি এক বন্ধুর প্রেমিকার জন্য? অন্য বন্ধুর প্রেমে না পড়ার জন্য? দুই বন্ধুর মাঝে অন্য নারী চলে আসার জন্য নাকি চিরাচরিত নবমী নিশির জন্য?

কে জানে! শুধু এটুকুই জানানো যাক, অন্য আরও অনেক কিছুর মতই সেই প্রেম পরিণতি পায় নি!


শেয়ার করুন...
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।