‘শিল্পকে কোলবালিশ করে বাঁচতে পারব না’, ঋত্বিক যা ভাবতেন আর কী

সংস্কৃতি
আসলে, ফ্লপ করেছিল দর্শক তিনি জানতেন ও বলতেন। আজ বি-এফ-আই শট-বাই-শটে ঋত্বিককে নতুন ভাবে আবিষ্কার করছে। বার্গম্যান-তারকভস্কির পাশে নাম হচ্ছে তাঁর। মুখ দিয়ে তাঁর উঠে আসা রক্ত গেঁথে রেখেছেন সুবিমল-দীপক-সন্দীপন-অনন্য-সঞ্জয়-নবারুণ-উদয়ন-মণি-জন’রা। সব তাঁরই তো ছেলেপুলে।... মঙ্গলবার ঋত্বিক ঘটকের জন্মদিনে নিজের ব্যক্তিগত অনুভূতির বিস্ফোরণ ঘটালেন দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়।

‘সব পুড়ছে/ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে/ আমি পুড়ছি’।

শেয়ার করুন...
  •  
  •  
  •  
  • 1
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
    1
    Share

১.

আজ মঙ্গলবার, ঋত্বিক কুমার ঘটকের জন্মদিন।
সুরমা ঘটক, তাঁর স্ত্রী, আমি তাঁকে দিদা ডাকতাম। তাঁর সাথে গত ১০ বছর অনেক সময় কেটেছে। ঋত্বিকের কালচারাল ফ্রন্ট আমায় উপহার দিয়েছেন তিনি। আমি চোখের সামনে দেখেছি এই পরিবারটাকে শেষ হয়ে যেতে। আমায় বলতেন, ” সবুজ। জীবন্ত।” বড় সব কিছু মনে পড়ছে আজ। দিদা আমায় ঋত্বিকের সাথে প্রেম, শিলং এর গল্প বলতেন। বলতেন, শিলং এ রবি ঠাকুরের কথা। বলতেন, দ্যাখ তো বাবা আমার লেখাগুলো যদি প্রকাশ করা যায়। আমি তাঁকে বলতাম আমার সময়ের গল্প। বলতাম জানো, এই ফোনে এখন ছবি বানানো যায়। অবাক হয়ে শুনতেন। কিন্তু বুঝতেন। আমার হাত ধরে অন্য ঘরে যেতেন। বলতেন, জানিস আমার কত প্রেমিক ছিল! কিন্তু তোর দাদু ছিল সবচেয়ে এগিয়ে। তাই ওকেই বিয়ে করেছি। বিভূতিভূষণকে চিঠি লিখতাম প্রেমের। সুভাষ বোস রেডিও-তে বার্তা দিতেন । তোর দাদুকে বিয়ে করব, বাড়িতে বলছে, ছেলে কি করে? তোর দাদুর জবাব, “কি করে মানে? বলবে, সংস্কৃতি আন্দোলনের কাজ করেন”

আরও পড়ুন:  ডিল্যুশনস অব এরোটোম্যানিয়া: ‘পাগলা গারদ’য়ে থেকে বেনজির ভুট্টোর অলীক প্রেমে পড়লেন ব্রিজ ভূষণ

দিদার কাছে ঋত্বিক জীবন্ত ছিলেন। বলতেন, ওঁকে দলের লোকেরা পলিটিক্স করে বের করে দিয়েছিল। পি সি যোশি শুধু পাশে দাঁড়ান। ৪৭ এ জেল খাটার গল্প বলতেন আন্ডারগ্রাউণ্ডে। বলতেন, ঋত্বিকের সেই খারাপ সময়েও দিদাকে দাস ক্যাপিটাল বলে ডাকার মজা। ম্যান মেকস হিমসেল্ফ পড়তে দেওয়া। কত কি মনে পড়ছে…ঋত্বিকের বইয়ের আলমারিটা ছিল ওই বাড়ির মূল আকর্ষণ..এরিক নিউম্যানের ‘গ্রেট মাদার’ বইটিতে ঋত্বিকের নোট নেওয়া চোখে পড়ত..ওঁর আইজেন্সটাইন, নাগার্জুনের সংগ্রহ আমায় বিস্মিত করত…পুনের ক্যম্পাসে কাজের সুবাদে গিয়ে চে গেভারার পাশে ঋত্বিকের গ্রাফিতিটা দেখে প্রবল গর্ব হয়েছিল বাঙালি হিসেবে এ শহরের জন্য আজ স্বীকার করলাম…

২.

নীতা কি চেয়েছিলেন?
একটা ঘর। সংসার। জীবন।
যখন তাঁর দাদা শিলং-র মানসিক হাসপাতালে গিয়েও জানায়, বাড়ির সবাই খুব আনন্দে আছে, বাচ্চা-কাচ্চা হয়েছে সবার, হইচই, নীতা কথা থামিয়েই চিৎকার করে

দাদা আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম…

ক্যামেরা ৩৬০ ডিগ্রি প্যান করে ঘুরতে থাকে। আসমুদ্র হিমাচল একাকার হয়ে যায় সে চিৎকার। ইতিহাস ও সাম্প্রতিক ভেঙে তছনছ করে। ছিটকে এসে রক্ত লাগে সমগ্র পুরুষতন্ত্রের সাদা পাঞ্জাবিতে। রবি ঠাকুর নীতাকে নিয়ে গান লিখলে লিখতেন, সকল গৃহ হারালো যার…। ঋত্বিক গ্রেট শিল্পীদের মতোই বড় নিষ্ঠুর। যেমন রবি ঠাকুরও। কিন্তু তারা কি জানতেন, আর তিন দশকের মধ্যে মেয়েদের ভূমিকার এমন বদল ঘটবে? সমাজের ভারসাম্যই যার জন্য যাবে বদলে?

আমার প্রজন্মেই ব্যপক হারে মেয়েরা সিঙ্গল ওমানহুড চাইল। পাশ্চাত্যে অনেক আগেই এই মোটিফ দেখা গিয়েছিল। আমাদের এখানেও ছিল। কিন্তু এত ব্যপক হারে হয়তো না। মেয়েরা আর “সংসার” চাইল না। কলেজ পাশ করার পর, তারা অনিশ্চিত কোনও একটা কাজের সূত্রে বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে লিভ-ইন করে নিল। দেখল, এ আসলে সংসারেরই ব্যপার। নতুন বোতলে পুরোনো মদ। তাঁকেই চাকরি থেকে ফিরে রান্না করতে হচ্ছে। তো, সেই মেয়ে বেরিয়েও এলো। কলকাতা মা-বাবা”র কাছেই ফিরে, কুকুর/বেড়াল পুষে, কম্পুটারে কাজে ঢুকে গেল। মাঝেসাজে এদিক ওদিক ফ্লার্ট করে নিল। যেমন পুরুষরাও করে।

জোর দিয়ে বলব, ব্যপক হারে আমার প্রজন্মে এই মোটিফ দেখা গেল মেয়েদের মধ্যে। আমাদের আগের প্রজন্মের লেখায় এই মোটিফ আসেনি। সন্দীপন খুব কাছে গেছেন। কিন্তু না, এই চিহ্ন নেই। ধরার সুযোগ পাননি। নবারুণ অন্য ভাবে ধরেছেন, “বেবি কে” জাতীয় লেখায়। আপনি বলবেন, মেয়েরা ফেমিনিটি হারালে তো ঘর ও বংশ ও রাষ্ট্র টলে যাবে। আমি একমত হব না। এটা ঠিকই ফেমিনাজিরা বদলা নিতে চায়। কারণ যুগ যুগ ধরে পুরুষ তাদের পুজো করেছে আর রড ঢুকিয়েছে। কিন্তু এমন অনেক মধ্যবিত্ত পড়ালেখা জানা নারী আগের প্রজন্মের আমি দেখেছি, যাদের স্পেস চাইতে আদালত বা ফেসবুকে আসতে হয়নি। তারা সংসার সামলেই নিজের অধিকার বুঝে নিয়েছেন। আর সে সংসারে কোনো এক্সপ্ল্যয়েটেশন নেই। আমার চারপাশে যে বন্ধুরা বিয়ে বা প্রেমের সম্পর্কে আছেন, এমন ভাবেই আছেন। আমি তাদের মধ্যে আগামী ৫০ বছরের বাংলাদেশ দেখতে পাই। দেখি, আজকের নীতাদের..দেখি সত্যজিতের মহানগরের মাধবী মুখোপাধ্যায়দের..যারা নিজেদের হক বুঝে নিতে জানেন..

৩.
মানুষ মারা যাওয়ার আগে কিছু কথা বলে যায়। প্রেমিকা ছেড়ে যাওয়ার আগে যেমন কিছু কথা বলে।
এ সব কথার ওজন খুব বেশি। সবার নয় এ সব কথা। বৌদ্ধরা তাই ভাইব্রেশন বুঝে, যার বুকে বুদ্ধ আছে, তাকেই বলে যান এ সব..কেউ তাঁর বই দিয়ে যান লাইব্রেরিতে। কেউ ফ্ল্যাট দিয়ে যান মিশনকে। কেউ অস্ত্র দিয়ে যান লড়াইয়ের। কবীরের গানে, কোনও সন্তানহারা মা জোড়া মুনিয়ার খাঁচা খুলে দেন..

সুরমা ঘটক যেমন বলতেন, ঋত্বিককে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে! সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, নীতাকে লো এঙ্গেলে যে রাতে মোর গানে যেভাবে দেখেন ঋত্বিক
তা বুর্জোয়াদের এতাবৎকালের সব দেখা ভেঙে দেয়। আমি দেখলাম, ওই মুহূর্তে বেঁচে উঠলেন ঋত্বিক। বেজে উঠলেন। ঋত্বিক যুক্তি-তক্কো”র শেষে যখন বললেন, কিছু একটা করতে হবে তো…মানিকবাবুর মদন তাঁতি মনে কর..সেটা তাঁর অন্তিম উচ্চারণ। সমস্ত প্রাণ ঠিকরে বেরলো তাতে..

প্রতুল মুখোপাধ্যায়র গান নিয়ে একটা বড় ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। তাতে উনি বলেছিলেন, মা মারা যাওয়ার আগে যেভাবে ওঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন, মনে হচ্ছিল, সমস্ত প্রাণ ঠিকরে বেরতে চাইছে। ঢুকে আসছে শরীরে। ট্রান্সমাইগ্রেট করতে চাইছে। যেমন পুশকিনের আত্মা ডস্টভয়স্কির শরীরে ও পরে কালভিনোর শরীরে ঢুকে যায়..প্রবাদে..আমি মানুষকে মারা যাওয়ার মুহূর্তে দেখেছি। আপনারা দেখেছেন? দেখেছি পায়খানা করে ফেলছে মানুষ। বা মদ ঢেলে দিচ্ছে স্ক্রিনে। বা, দেবদূতের মতো পরীর হাতে বিলিয়ে দিচ্ছে আত্মা। নীল চোখ নিয়ে তারপর শুয়ে পড়ছে কফিনে। গুরুস্থানীয় কিছু মানুষ আমায় কিছু কথা বলে গেছেন। যা, আমি এ জীবনে কাউকে বলতে পারব না।চেষ্টা করব, সে কথার সম্ভ্রম রাখতে, কাজে। মাঝে মাঝে, মারা যাওয়ার কথা ভাববেন। দেখেবন মনে হবে, সমুদ্রের সামনে বসে আছেন। বুনুয়েল যেমন ডাইরিতে রীতিমত ফ্যান্টাসি করে ফেলেছিলেন কীভাবে মারা যাবেন তা নিয়ে। বাথরুমে না দেবালয়ে। প্রেমিকাদের সাথে কাটানো স্মৃতিগুলোর কথাও ভেবে গেলেন পরপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণের আগে।

ট্রেন যদি জীবন হয়, কাশবন পেরিয়ে অপু কিন্তু তা দেখতে পেল, দুর্গা পেল না। পা মচকে পড়ে গেল। নারীবাদী ব্যখ্যায় রুশতী সেন এমনটাই লিখেছিলেন। বা, অপর্ণা”র মারা যাওয়ার খবরে থাপ্পর মারে অপু। মুখ বেঁকে যায়। নীতাকেই আত্মত্যাগ করতে হল। শেষ সিনে আরেক নীতাকে আমরা আবার দেখলাম কলেজ যেতে একই ছবিতে। মাও বলেন, কারও মারা যাওয়া পাহাড়ের মত ব্যাপক আর কারো পালকের চেয়েও হালকা। মানুষ মারা যায় ঠিকই। মানব থেকে যায়। আর তাকে অগ্রজের কাজের ভারও শোধ করতে হয়, এক জীবনেই। চুল্লিতে হাত-পা-মাথা-ঘিলু ফেটে যাওয়ার আগে! ততদিন জীবন জীবিতের বিশ্বাস করতেন ঋত্বিক।

৪.

ঋত্বিক ঘটকের গল্প নিয়ে বাংলায় বিশেষ কেউ আলোচনা করেননি। অথচ লোকটা গল্পগ্রন্থে প্রায় ১৮/১৯টি গল্প লিখেছেন। এ ছাড়া লিখেছেন কবিতা-নাটক সহ অজস্র লেখা। কিন্তু আমাদের একটা স্বভাব, একজন কোনও বিশেষ একটা কাজে দক্ষ তাই তাঁর আর অন্য কাজের খোঁজ না রাখা। ঋত্বিকের লেখা নিয়ে সেটাই হয়েছে। বাঙালির অবহেলা। যতটা তাঁর মদ্যপান নিয়ে আলোচনা হয়েছে, লেখা নিয়ে তার সিকিভাগও হয়নি। একমাত্র, বাংলা ভাষায়, তাঁর লেখা নিয়ে জরুরি আলোচনা করেছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় আর অবশ্যই নবারুণ ভট্টাচার্য। এ ছাড়া শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়। কালচারের হোতারা অবশ্য তাতে বিশেষ কল্কে দেয়নি।

বাঙালির একটা সোভিয়েত ছিল এককালে। ছিল। কারণ, আজ আর তা নেই। ৯১-সালে সেই সোভিয়েত মারা যায়। ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা লেখেন, এন্ড অব হিস্ট্রি। নবারুণ বলেন, অনেকেই তাঁর মত আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছিলেন এরপর। কিন্তু সে সময়েই হারবার্ট লেখা হয়। আত্মহত্যা করেন হারবার্ট। নবারুণ বেঁচে যান। এবং ঘটনায় নড়ে যায় প্রশাসন ও রাষ্ট্র।

বাঙালির সোভিয়েত ছিল- বলছিলাম। তাই লেনিনগ্রাদে মেঘ করলে দেশপ্রিয় পার্কের লা কাফেতে ঝড়জল হত। সস্তায় রপ্তানি হত ভস্তক-রাদুগার বই। বরিস পলেভয়-গোর্কি-তলস্তয়-পুশকিন থেকে সোলঝিনিৎসিন-পাস্তেরনাক-মায়ারহোল্ড- বুলগাকভ। লেনিন-স্তালিন-আইজেনস্টাইন। মানুষের মত মানুষ-ইস্পাত-মা-দুনিয়া কাঁপানো দশদিন-ফাঁসির মঞ্চ থেকে। বাঙালি সত্তর দশকে তাই কিছুটা ফরাসি এবং অনেকটাই রাশিয়ান হয়ে উঠেছিল। শিল্প-সমাজ-পরিবেশের আকাশে বাতাসে ছিল রাশিয়ার ঘোর। সেই ঘোরাচ্ছনতা সেই রোমান্স থেকেই তাঁরা জীবন দেখতেন। উত্তাল হত কফি হাউস। রাসবেহারী মোড়। মিছিলের মুঠো। রাস্তার গুলির শব্দ। বোমা। যুবকের ভেসে যাওয়া লাশের পাহাড়। বরানগর-কাশীপুর। নকশালবাড়ি। ফ্রান্স-৬৮। আপামর দুনিয়ার ছাত্র প্রতিবাদ। দেওয়াল লেখা। কবিতা-নাটক-মিছিল।

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে মণিভূষণ ভট্টাচার্য, কবিতার ধাঁচ দেখলেই বোঝা যায়, এই চলন স্রেফ বাংলার না।এখানে মিশে আছে রাশিয়া। মিশে আছেন মায়াকভস্কি। মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে যিনি কবিতা বলবেন তাঁর কাজে লাগবে এই কবিতা। অনেকটা সুভাষ মুখোপাধ্যায় যেমন। সচেতন ভাবেই যেন সোজাসাপ্টা লেখা। সিধে। কাব্য নেই। আছে ম্যানিফেস্টো। সুকান্ত ভট্টাচার্য যার জ্বলন্ত উদাহরণ।

ঋত্বিক ঘটকের গল্প “কমরেড” বা “আকাশগঙ্গার স্রোত ধরে”-তে একটা সোভিয়েত প্রভাব পাই আমি। তাঁর গদ্যে সোভিয়েত গদ্যের প্রভাব আছে। আছে নিপাট বাংলাও। কিন্তু মতাদর্শ আর গদ্যচলনে আছে সোভিয়েত। আমার মতে। যার সরাসরি প্রভাব আছে নবারুণের গদ্যে। এ নিয়ে কেউ আজও কথা বলেনি। আমার একটা দীর্ঘ লেখা লেখার ইচ্ছে অনেকদিনের। এখানে তার কয়েকটি সূত্র উল্লেখ করব।

শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছেন, দেশভাগের ট্রমা কীভাবে মিশে যাচ্ছে ঋত্বিকের গদ্যের চরিত্রে। মিশে যাচ্ছে মূল্যবোধহীনতা। ভেঙে যাওয়া পরিবার। ভেঙে যাওয়া সমাজ। আশ্রয় খুঁজছেন ঋত্বিক। কালিদাসের মেঘের বর্ণনার মতোই একা তাঁর চরিত্ররা। খুব একা। কার্যত গোপাল হালদার ভূমিকাতেও এই সমাজের ভেঙে যাওয়া আর তার প্রভাবের কথা মোটা দাগে বলছেন।

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে নবারুণ বন্ধু হিসেবে কিছু স্মৃতির কথা জানান। ভবানীপুরে তাঁর, বাবা বিজন ভট্টাচার্যর আর আত্মীয় ঋত্বিকের সাথে দারিদ্রময়, মলিন অথচ মেধাবী বেঁচে থাকার সূত্রে। সেখানে নবারুণ বলেন, মা-হীন বালক নবারুণকে ভালোবেসে প্রতি সপ্তাহে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন ঋত্বিক। বিদেশী ছবি। ফেরার পথে সে ছবির গল্প গুছিয়ে বলে দিতেন, যাতে বালক নবারুণের বুঝতে অসুবিধে না হয় ছবিটি। একটি ইন্টারভিউতে নবারুণ জানান,

” দ্যা ওয়ে ঋত্বিক গিলছিল পাশে বসে ইভান-স চাইল্ডহুড, আমি বুঝেছিলাম, এর একটা বিস্ফোরণ ঘটবে। ঋত্বিকের পরের ছবির কাজে তারকভস্কির গভীর ছাপ ছিল।”

এই যে ঋত্বিকের স্টোরি টেলিং, তার প্রমাণ আমরা পাই এ গল্পগুলোয়। এবং অবশ্যই নবারুণের গদ্যে। নবারুণের কবিতাতে তো সোভিয়েত ছাপ স্পষ্ট। গদ্যেও
ঋত্বিকের হাত ধরে স্বরের ভাষায় প্রকট সোভিয়েত স্টোরি টেলিং। অনেকেই ঋত্বিকের বাড়ির বইয়ের আলমারিতে আইজেনস্টাইনের সংকলন দেখেছেন। দেখেছেন কি যত্ন করে ফুটনোট নেওয়া সেখানে। এ ছাড়াও নবারুণের কাছে ঋত্বিকর এরিক নিউম্যানের লেখা গ্রেট মাদার বইটিতেও রয়েছে যত্ন করে ফুটনোট নেওয়া। অর্থাৎ, মন দিয়ে, গভীর অভিনিবেশ দিয়ে তিনি পড়তেন। পড়েছিলেন ইয়ুং যেমন। মাদার কাল্টের সূত্রে। পড়েছিলেন মানিক। মদন তাঁতি। আইজেনস্টাইন।”গিলেছিলেন” ইভান-স চাইল্ডহুড। আর সেগুলির স্টোরি টেলিংর প্রভাব আছে নবারুণের গদ্যে।

আমার কাজ থিওরি খারা করা না। শিল্প ওভাবে হয়ও না। আমি আমার আন্দাজের কথা বললাম। কিছু প্রমাণ দিয়ে। নিদান দিচ্ছি না। কমলকুমারকে ফরাসি সাহিত্য দিয়ে ব্যাখ্যা করে, মিথ বানিয়ে অনেকটাই, বাঙালি অনেক বেওসা করেছে। কারণ তাঁর কোনও উত্তরাধিকার নেই। অথচ হুতোম আছে, আছে শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের প্রভাব তাঁর গদ্যে। আমি তাই “বিদেশ” দিয়ে কখনওই ব্যাখ্যা করছি না ঋত্বিকের গদ্য। বলছি, একটা প্যাটার্ন যা হয়তো নবারুণের গদ্যের অবচেতনের স্বরে ছিল। কারণ নবারুণ তো শেষ মোহিকান বিজন ও ঋত্বিক ঘরানার।

ইন্টারন্যাশনাল বাজলে বুলেট ফুলেট পরোয়া করব না-বলতেন নবারুণ। সোভিয়েত নস্টালজিয়া থেকে আজীবন তিনি বা তাঁর প্রজন্ম বেরতে পারেননি। হাজার ভুলের কথা জেনেও। যেমন বেরতে পারেননি ঋত্বিকের ও বিজনের প্রভাব থেকে। এবং সন্তানসম আমাদের রক্তে মিশিয়ে দিয়ে গেছেন সে সংক্রমণ। এবং নবারুণ ও ঋত্বিক-দু জনেই আজ সবকিছু ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক, সদর্থে।

৫.

ঋত্বিক ঘটক আজ কমোডিটি। বিক্রি করা যায় ভালো। যেমন কমোডিটি সত্তর, নকশাল। এ শহরের পূর্ণ সিনেমা হলে কোমল গান্ধার পোড়ানো হয়েছে। আর আজ মেঘে ঢাকা তারা-র রিমেক বাজারে পাওয়া যায় সস্তায়। আজ আরেক দেশভাগ-মহামারী-মন্বন্তরের সামনে আমরা। আজ কলকাতা ফেস্টিভ-এলইডি-আইপিল-স্কাইপে। আইপিল আর আইপিএল। পুরো ফ্যাব, ইন্ডিয়া। স্বচ্ছ, ভারত! আজকের খুশিখুশি তন্বীরা জানে না, কেন ঋত্বিকের মুখে রক্ত উঠে আসত! ফ্রেম ভেঙে কেন রাপচার নেমে আসত আর শোনা যেত দোহাই আলি দোহাই আলি! কেন বাংলা ঢেলে দিতে হয় সাদা পাতায়..
সত্যিই বীভৎস মজা! কেচ্ছা-অপমান-খিস্তি-ল্যাং মারামারি-কাঠিবাজি-ফোড়ন কাটা-দাঙ্গা-দুধে সোনা-এম্বুলেন্স আটকানো-গো মূত্র-গোলি মারো। সবাই কবি-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী-সেলিব্রিটি। জেন-এক্স আর ফ্রি-সেক্স। ফি বিকেলে ডলিসে পেছন দুলিয়ে চলছে দাঙ্গা-দিলীপ ঘোষ-অনুব্রত-পিএইচডি-সেপারেশান। কম্বো। আমি-বর-বস-ফেসবুক। ব্যাস। ফ্যাবইন্ডিয়া-মাগিবাজি-ঢ্যামনামো-এঁটোকাটা-মালখাওয়া-পিআর-তানিশক। এলঈডি-মেডিক্লেম-সেভিং একাউন্ট-ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স-বাইপাসের ধারে ফ্ল্যাট আর রাজারহাট নজরুলতীর্থ। স্বস্তির চর্বি গদগদ কি ভীষণ স্তনবতীদের। তরুণ লেখক সম্পাদককে থানার বড়বাবু ভেবে হাত কচলাচ্ছে। কমপ্ল্যান খুকি মিছিল থেকে ফিরে এসি চালিয়ে টেডিবিয়ার জাপ্টে স্পাইডারম্যানকে বলছে, করছ না কেন আমাকে? করো!

‘সব পুড়ছে/ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে/ আমি পুড়ছি’। কলকাতা তো এখন একটা চুল্লি। চকচকে চুল্লি। ইতরের দেশ। ধর্ষণ করে সেলফি তোলা হয় রাজারহাটে। ফেসবুকে আত্মহত্যার কথা লিখে সেনসেশান বাড়ানো। ওটুকুই ধক। সম্পাদক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন তাঁর ফ্রেম কাঁপে। সিনেমাগুলি তাই হয়নি। এ জাতি আরও অনেক জিনিয়াসের মতোই তাঁকে উন্মাদ বানায়। অথচ তিনি গ্রামার বানাচ্ছিলেন। স্কিতসফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হন ঋত্বিক শেষবেশ।

আসলে, ফ্লপ করেছিল দর্শক তিনি জানতেন ও বলতেন। আজ বি-এফ-আই শট-বাই-শটে ঋত্বিককে নতুন ভাবে আবিষ্কার করছে। বার্গম্যান-তারকভস্কির পাশে নাম হচ্ছে তাঁর। মুখ দিয়ে তাঁর উঠে আসা রক্ত গেঁথে রেখেছেন সুবিমল-দীপক-সন্দীপন-অনন্য-সঞ্জয়-নবারুণ-উদয়ন-মণি-জন’রা। সব তাঁরই তো ছেলেপুলে। চেতলার একরত্তি ঘরে আইজেন্সটাইন সংগ্রহ..ওই ভেঙে যাওয়া ফ্রেম তো রুনু গুহ নিয়গীর নাগাল টপকে মৌলালির অন্ধকার বাড়ি থেকে চারু মজুমদারের উড়ন্ত বাঘের থাবা। উড়ে যাওয়া ব্রিজ। সন্দীপনের থেকে ধার নিলাম শব্দগুলো। মানিকের মদন তাঁতি। শঙ্কর গুহ নিয়োগীর শ্রমিক হাসপাতাল পরিকল্পনা। সারি সারি গরাদ ভেঙে বেরিয়ে আসা জুলিয়াস ফুচিক, শ্রীঅরবিন্দ, গ্রামশি, সক্রেটিস, চে গেভারা। সুখি-সুখি, খুকু-খুকু, প্রতিষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান পাশবালিশ সাহিত্যের উপর লং-মার্চ, গীতা ও রবীন্দ্রসংগীতের রক্ত। বন্ধ কারখানার সামনে থুথু ও পেচ্ছাপের পাশে বসে শ্রমিকদের সুদিনের গল্প শোনাচ্ছেন ভ্লাদিমির লেনিন। সত্যজিৎ রায় বলছেন, বাংলাদেশকে উনি যেভাবে দেখেছেন তা আমি পারতাম না।
আর, স্বয়ং ঋত্বিক বলছেন, ‘আমৃত্যু আমার জীবনে কম্প্রোমাইজ করা সম্ভব না। যদি সম্ভব হত, তাহলে অনেক আগেই করতাম। আর ভালো ছেলের মত গুছিয়ে বসতাম। কিন্তু তা হল না। হয়তো হবেও না। তাতে বাঁচতে হয় বাঁচব, নয়তো বাঁচব না। কিন্তু শিল্পকে কোলবালিশ করে বাঁচতে পারব না।’


শেয়ার করুন...
  •  
  •  
  •  
  • 1
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
    1
    Share

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।