মন খারাপ হবে না? পর্দায় তিনি যে বাঙালির রোল মডেল ডাক্তার

সমকাল সংস্কৃতি
‘অপুর সংসার’য়ের অপু থেকে শুরু করে, ‘ঝিন্দের বন্দী’র ময়ূরবাহন হয়ে ‘তিন ভুবনের পারে’ বা ‘সংসার সীমান্ত’ বা ‘কোনি’র ক্ষিদ্দা কি সর্বোপরি বাঙালির ম্যাটিনি আইডল ফেলুদার ভূমিকায় জিন্সের প্যান্ট, পাঞ্জাবি আর চারমিনার হাতে তাঁর অভিনয় যেমন কোনওদিনই ভুলতে পারবে না কেউ, ঠিক তেমনই  চিকিৎসকের ভূমিকায় তাঁর  অভিনয়ও কিন্তু বাংলা ছবির ইতিহাসে মাইলস্টোন হয়ে থাকবে। লিখছেন স্বাস্থ্য ইতিহাসের গবেষক নটরাজ মালাকার।

সত্য়জিৎ রায়ের ‘গণশত্রু’ ছবিতে ডা. অশোক গুপ্ত-র ভূমিকায়।

শেয়ার করুন...
  •  
  •  
  •  
  • 1
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
    1
    Share

চলে গেলেন বর্ষীয়ান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৫-২০২০)। গত ৫ অক্টোবর কোভিড পরীক্ষার ফল পজিটিভ আসার পর তাঁকে কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।  পরে তাঁর কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ আসে ঠিকই,  এর পর থেকে তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা ক্রমশ অবনতি হতে শুরু করে। কিন্তু ডাক্তাররা হাল ছাড়েন না। সিনেমার পর্দার এক কিংবদন্তী ডাক্তারকে বাঁচাতে তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছিলেন। কিন্তু টানা ৪০ দিন লড়াইয়ের পর শেষ অবধি…। অভিনেতা একসময় কাব্যিকভাবে বলেছিলেন—  তিনি যেন সারা জীবন একই সিনেমাতে অভিনয় করে চলেছেন। সত্যিই তো। লড়াকু ডাক্তার হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যেভাবে নিজেকে একের-পর-এক ছবিতে উপস্থাপন করেছিলেন তা দেখে হয়তো দর্শকেরও  মনে হয়েছে. তিনি যেন তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্বকে তুলে ধরছেন একে-একে, এক-এক করে। ‘অপুর সংসার’য়ের অপু থেকে শুরু করে, ‘ঝিন্দের বন্দী’র ময়ূরবাহন হয়ে ‘তিন ভুবনের পারে’ বা ‘সংসার সীমান্ত’ বা ‘কোনি’র ক্ষিদ্দা কি সর্বোপরি বাঙালির ম্যাটিনি আইডল ফেলুদার ভূমিকায় জিন্সের প্যান্ট, পাঞ্জাবি আর চারমিনার হাতে তাঁর অভিনয় যেমন কোনওদিনই ভুলতে পারবে না কেউ, ঠিক তেমনই  চিকিৎসকের ভূমিকায় তাঁর  অভিনয়ও কিন্তু বাংলা ছবির ইতিহাসে মাইলস্টোন হয়ে থাকবে।

 

আরও পড়ুন:  ‘শিল্পকে কোলবালিশ করে বাঁচতে পারব না’, ঋত্বিক যা ভাবতেন আর কী

১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত স্বদেশ সরকারের ‘জীবন সৈকতে’ সিনেমাতে চিকিৎসা পেশার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো দিকই ফুটে উঠেছিল। সার্জেন সম্বিত ব্যানার্জি ছিলেন একজন আদর্শবান চিকিৎসক। তিনি নিম্নবিত্তদের চিকিৎসা করতে চেয়েছিলেন। কোনও দিন বিদেশে যাননি। দেশে থেকেই তাঁর কাজ করার প্রবল ইচ্ছে ছিল। ডা. ব্যানার্জি একটি দাতব্য হাসপাতাল ও তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত একটি ছোট ডিসপেনসারিতে প্র্যাকটিস করতেন। কিন্তু ধীরে-ধীরে তাঁর মহৎ উদ্দেশ্যের কথা ভুলে যান তিনি। বাড়ির ডিসপেনসারিতে প্র্যাকটিস বন্ধ করে দিতে থাকেন। শহরের নামি নার্সিংহোমের পাতা ফাঁদে তিনি পা দেন এবং তাদের দেওয়া মোটা অঙ্কের অর্থের প্রস্তাবে তিনি রাজি হয়ে যান। ক্রমশ তিনি হয়ে ওঠেন এক অর্থলোভী চিকিৎসক। রোগীকে ঠকাতে বা রোগীকে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে তাঁর আর বিবেকে বাধে না। পেশাগত জীবনে এই পরিবর্তনের প্রভাব তাঁর সাংসারিক জীবনেও পড়েছিল। তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী (অপর্ণা সেন)। কিন্তু অবশেষে ডা. ব্যানার্জি তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। আবার নতুনভাবে সব কিছু শুরু করতে চেয়েছিলেন।

ইবসেনের ‘এনিমি অব দ্য পিপল’ নাটক থেকে সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘গণশত্রু’(১৯৯০)-তে উঠে এসেছিল জনস্বাস্থ্যের জন্য এক ডাক্তারের লড়াইয়ের কাহিনী। সিনেমাটি এমন সময় মুক্তি পেয়েছিল যখন হিন্দুত্ব নিয়ে মেতে উঠেছিল দেশ। দু’বছর পর ঘটে গিয়েছিল বাবরি মসজিদ ভাঙার মতো ঘটনা। সিনেমাতেও এমন এক পরিস্থিতির আঁচ পাওয়া গিয়েছিল। বৃহৎ হিন্দু-সমাজের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে কুসংস্কার, অযুক্তি, ধর্ম নামক আফিমের নেশার বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছিল চণ্ডীপুরের ভূমিপুত্র প্রগতিশীল চিকিৎসক অশোক গুপ্তকে। প্রসঙ্গত বলা দরকার, ব্যক্তি সৌমিত্রও ছিলেন প্রগতিশীল। তাই ধর্ম নিয়ে সৌমিত্রের কোনও মাথা ব্যথা ছিল না। যিনি নিজেই বলেছিলেন, পরজন্মে তাঁর বিশ্বাস নেই। যাইহোক, ডা. গুপ্ত পশ্চিমবঙ্গের একটি কাল্পনিক মফস্বল শহর চণ্ডীপুরে ২৬ বছর চিকিৎসা করেছেন। স্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য শহরটির সুনাম ছিল এক সময়ে। কিন্তু এই অবস্থার অবনতি হতে শুরু করলো। শহরের সবচেয়ে জনবহুল এলাকা ভুবনপল্লীর পানীয় জলে রোগের বীজাণু পাওয়া গেল। ডা. গুপ্ত এই বিশেষ অঞ্চলের জল কলকাতায় পাঠিয়ে ‘অ্যানালিসিস’ করিয়েছিলেন এবং প্রাপ্ত রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে তিনি জনবার্তা পত্রিকা পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লিখে জনগণকে সচেতন করতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, এইভাবে জলবাহিত রোগে মানুষ আক্রান্ত হতে থাকলে চণ্ডীপুরে অচিরেই মহামারি দেখা দেবে। কিন্তু ভুবনপল্লী অঞ্চলেই ছিল এক পেল্লায় মন্দির। যেখানে হাজার হাজার পুণ্যার্থীর আনাগোনা। মন্দিরকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল এক বিরাট ব্যবসাও। মন্দিরের চরণামৃতে রোগের বীজাণু প্রমাণিত হলে ধর্ম ব্যবসার ক্ষতি হবে। তাছাড়া বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে হলে পৌরসভার অনেক টাকা খরচ হতো। তাই স্বাভাবিক ভাবেই রাজনৈতিক চাপ তাঁকে কণ্ঠরুদ্ধ করতে এগিয়ে এলো।  সেই সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো ধর্মকে, রাজনীতির হাতিয়ার করে। তাঁরই ডাকা জনসভায়  তাঁকে প্রকাশ্যে প্রশ্ন করা হলো—“আপনি নিজেকে হিন্দু বলে মনে করেন?” প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল যে তিনি যেহেতু নাস্তিক সেহেতু চরণামৃতের জল নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তারপর? তাঁকে ‘গণশত্রু’তে পরিণত করা হলো। যদিও তিনি লড়াইয়ের ময়দান থেকে সরে এলেন না। এতদিনের চেনা লোকগুলো পাশ থেকে সরে এলেও তিনি একাই রয়ে গেলেন ময়দানে।  ইবসেন মনে করতেন, যে মানুষটা একা, সে-ই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। মনে করতেন, তাঁর নাটকের সেই চিকিৎসকও।

১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায়ের ‘উত্তরণ’ ছবিতে ডা. সেনগুপ্ত উচ্চবিত্ত মানুষের চিকিৎসা করলেও দেখা যায় গরিবের স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেননি। রাস্তায় পড়ে থাকা গরিব রোগীর চিকিৎসা করতে দেখা যায় তাঁকে। তিনি শুনেছিলেন সরকার জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য অনেক কিছু করেছে। কিন্তু স্বচক্ষে গ্রামের স্বাস্থ্য চিত্র দেখার পর তাঁর ধারণা বদলে গিয়েছিল। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ২০ বছরের উন্নতি নিয়ে তাঁর লেখা প্রবন্ধ তিনি শেষে পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই যাবতীয় উন্নতির বাইরেই রয়ে গিয়েছে উন্নয়নের মূল ছকের বাইরে থাকা মানুষগুলো।

 

ওই একই বছরে মুক্তি পায় তপন সিংহের ‘হুইল চেয়ার’ (১৯৯৪)। সেখানে পক্ষাঘাতগ্রস্ত এক লড়াকু চিকিৎসকের ডা. আর মিত্রের চরিত্রে অভিনয় করাটা ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ। পুরো ছবিতে হুইল চেয়ারে বসে অভিনয় করেও দর্শককে মুগ্ধ করেছিলেন তিনি। ছবিতে দেখা যায় ডা. মিত্র একজন নিউরোলজিস্ট। তিনি একজন যুক্তিবাদী মানুষ, যিনি বলেন মৃত্যুর পর কী আছে তা কেউ জানেন না। ব্যক্তি সৌমিত্রের চরিত্র ও সিনেমার চরিত্র কোথাও যেন মিলে মিশে এক হয়ে যায়। লন্ডন থেকে বার্মিংহাম যাওয়ার পথে একটি দুর্ঘটনাতে ডা. মিত্রের মাজা থেকে পা পর্যন্ত পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। কলকাতায় ফিরে এসে নিউরোলজিকাল পেশেন্টদের একটি হোমে ডাক্তার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। আপন করে নিয়েছিলেন হোমের মানুষদের এবং নিজের স্বার্থ নিয়ে মেতে থাকা বৃহত্তর সমাজের বিপরীতে হোমকে তিনি একটি মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যেখানে সকল সদস্য ছিলেন ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে। নিজের প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে মনের জোরে লড়ে গিয়েছিলেন ডাক্তার। হুইল চেয়ারে বসেই দেশ-বিদেশের সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং নিউরোলজির অনেক জ্ঞান সঞ্চয় করেছিলেন তিনি। হোমের জন্য সরকারি সাহায্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর লড়াইটা আরও কঠিন হয়ে গিয়েছিল। হোমকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা প্রমাণ করে দিয়েছিল যে মুষ্টিমেয় মানুষও যদি এগিয়ে আসে তাহলেও সমাজের জন্য অনেক কিছু করা যায়। ধর্ষণের মুখে পড়ে সাময়িকভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া এক যুবতী (লাবণি সরকার)কে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনেন তিনি। এমন চিকিৎসকই তো বাঙালির হার্টথ্রব!

নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ২০১৩ সালে মুক্তি পায় ‘অলীক সুখ’। ছবিতে  ডাঃ কিংশুক গুহ (দেবশঙ্কর হালদার) একজন নামকরা গাইনোকলজিস্ট সার্জেন। কিন্তু তিনি চিকিৎসাব্যবসায়ী। বিশ্বায়িত ভোগবাদ তাঁকে গ্রাস করেছে। তবে তার পাশেই হাজির কিংশুকের শিক্ষক ডা. অম্বরীশ রায়(সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)। সেবাপরায়ণ এক চিকিৎসক। সিনেমাতে আমরা ডা. অম্বরীশ রায় রূপে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে খুব অল্প সময়ের জন্য দেখতে পেলেও এই চরিত্র দর্শকের মনে অবশ্যই দাগ কেটে দিয়েছে। কবিতা (কিংশুকের পেশেন্ট) মৃত্যু কেসের তদন্ত দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন ডা. রায়। কিংশুক ভেবেছিলেন, ‘স্যার’ তাঁর পক্ষে কথা বলবেন। কিন্তু ডা. অম্বরীশ ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। তিনি কিংশুকের ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন হিপক্রেটিসের শপথের কথা। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, চিকিৎসক চরিত্রে অভিনীত বেশিরভাগ ছবিতে সৌমিত্রবাবু হিপক্রেটিসের শপথের কথা নিজস্ব ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেছিলেন। সার্কুলার ট্রলিতে বসানো ক্যামেরা ঘুরতে থাকছে আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একের-পর-এক প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে যাচ্ছেন দেবশঙ্কর হালদারকে, অলীক সুখ-এর ওই আইকনিক দৃশ্য বাঙালি অন্তত কোনওদিন ভুলতে পারবে না।

বাঙালির রোল মডেল এমন ডাক্তার-চরিত্রকে বাঁচাকে কত চেষ্টাই-না করলেন কলকাতার চিকিৎসকরা। মন খারাপ হবে না?

 

 

 

 

 

 

 

 

 


শেয়ার করুন...
  •  
  •  
  •  
  • 1
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
    1
    Share

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।