হায় সেই মায়া ঝরা সন্ধ্যা

ঢাকের বাদ্যি সংস্কৃতি
 সে একটা অন্যরকম মায়া। শরতের আকাশের মায়া। বাতাসের শিরশিরানির মায়া। শিউলি ফুলের মায়া। ... হাজরা মোড়ে গাছ ছিল, তাতে শিউলি ফুল ফুটত। হাজরা পার্কে কর্পোরেশনের পুজো হতো। মাসীমা মেসোমশাইরা সিনেমা দেখতে যাচ্ছেন। এবং ফিরছেন। কী সব দিন! ম্যাটিনি, ইভিনিং এমনকি নাইট শো-ও হাউসফুল। এ কিন্তু আইনক্স বা ফোরাম নয়। এই বিজলিতেই তো প্রায় ন-শো সিট। লিখছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্য়ায়।

শেয়ার করুন...
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এটাই তো স্বাভাবিক ছিল যে, সপ্তমীর সন্ধ্যায়, রাস্তায় আলোর মালা, একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে, জমে থাকা জল চিকচিক  করছে আর যে-নতুন জামাই গরদের পাঞ্জাবি পরে ‘পূর্ণ’তে সিনেমা দেখতে ঢুকেছিলেন, সস্ত্রীক শ্যালিকা-সহ, তিনি বাইরে বেরিয়ে এসে ধুতিটা একটু উঁচু করে তুলতে বাধ্য হলেন। তারপর শ্রীহরির কচুরি আর ছোলার ডাল খেয়ে ফিরলেন। আসলে বাঙালির জীবনে যৌথ উৎসব হিসেবে পুজো যেমন উঁচুতে জায়গা পায়, তেমনি পুজো কীভাবে কাটাবো– তা আগে, খাওয়াদাওয়ার  চাইতে, রেস্তোরাঁয় যাওয়ার চাইতে, অনেক বেশি সেলিব্রেট করা হতো সিনেমা দেখতে যাওয়া দিয়ে। সিনেমা, এই আড়াই ঘণ্টা বা তিন ঘণ্টার যে আমোদ বা বিনোদন, তাই-ই আমাদের মুহূর্তের জন্য ছুটির দিনের  সঙ্গে এক করে দিতো।  সে একটা অন্যরকম মায়া। শরতের আকাশের মায়া। বাতাসের শিরশিরানির মায়া। শিউলি ফুলের মায়া।  আমার এখনও মনে আছে হাজরা মোড়ে গাছ ছিল, তাতে শিউলি ফুল ফুটত। হাজরা পার্কে কর্পোরেশনের পুজো হতো। মাসীমা মেসোমশাইরা সিনেমা দেখতে যাচ্ছেন। এবং ফিরছেন। কী সব দিন! ম্যাটিনি, ইভিনিং এমনকি নাইট শো-ও হাউসফুল। এ কিন্তু আইনক্স বা ফোরাম নয়। এই বিজলিতেই তো প্রায় ন-শো সিট। হলের সামনে এক দম্পতি কাতর অনুনয় করছেন—‘দাদা (টিকিট) হবে নাকি’?

 

হবে কি হবে না, কেউ জানে না। কিন্তু সিনেমার হাওয়াটা ছিল এরকমই। তখন নিয়ম করে অগস্ট কি সেপ্টেম্বর মাসে  দেখা দিত নতুন সিনেমা, বাঙালির হৃদয় আকাশে। প্রথম মনে হয় দেখা দিয়েছিল ‘মুক্তি’ ছায়াছবির  সঙ্গে-সঙ্গে। সঙ্গীত মুখরিত, নিসর্গে চিত্রিত, প্রথমেথ বড়ুয়ার এই ছবিটি মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৩৭ সালে। তখনকার দিনে ‘দেশ’ বলুন, ‘বসুমতী’ বলুন, সবাই একমত হয়েছিল পুজো একরকম রঙিন হয়ে উঠেছে। আমার মনে হয়, বাঙালির পুজোতে সিনেমার মুক্তির এই মুহূর্ত  বড়়ুয়া সাহেবের হাত ধরেই এসেছে। সেখানে, প্রথমেশ চলে যাচ্ছেন দূরে। বাঙালিও পুজোর ছুটিতে কাছে-দূরে বেড়াতে যেত। ছোটনাগপুরে, হাজারিবাগের উপত্যকায়। তেমনভাবেই প্রমথেশ তাদের হাত ধরে নিয়ে গেলেন ট্যুরে। এই ট্যুরে যাওয়াটাই তখন সিনেমা দেখতে যাওয়া ছিল। তখন বাঙালির হাতে পয়সা বেশি ছিল না কিন্তু হৃদয় অনেকখানি ছিল। উত্তম-সুচিত্রা বা কোনও উত্তম-কাহিনি বাঙালিকে টানতো।  আড়াই তিনঘণ্টার জন্য তারা ভুলে যেত দৈনন্দিন জীবনের লাঞ্ছনা অথবা দেওয়ালে সেকেলে হলুদের দাগ কিংবা সেই একঘেয়ে কড়াইয়ের বেগুনভাজার চটপটি আওয়াজ।

 

বিভূতিভূষণের অপু  আশ্রয়দাতা অখিলবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিল, “বায়স্কোপ যেখানে হয়, এখান থেকে কতদূর”। গ্রাম থেকে শহরে আসার সেই গল্পে, সেই নাগরিকতার সূচনায়, সারা পৃথিবীতে,  সিনেমাতে এই আধুনিকতার যে- হস্তক্ষেপ তাকে বুঝতে গেলে শিক্ষিত মানুষ  ওয়াল্টার বেঞ্জামিন প্রমুখ চিন্তকের  শরণ নিতে পারেন। কিন্তু কৌতূহল যা জাগায় তা হল, অপুর দেওয়ানপুর স্কুলের ভ্রাম্যমান চলচ্চিত্রের কলকাতায় ঠাঁই পাওয়া শুরু হলো বিশ শতকের শুরু থেকেই।  তখন রবীন্দ্রনাথ  নোবেল পাচ্ছেন। বাংলা ছবির আদিপর্বে যাঁদের সবচেয়ে বেশি রমরমা সেই ম্যাডানরা তৈরি করছেন, ‘এলফিনেস্টন পিকচার প্যালেস’। এখন যা ‘সোসাইটি’ নামে পরিচিত। আজকের ‘চ্যাপলিন’, ‘মিনার্ভা’ নামে যাত্রা শুরু করে তারও আগে। হলগুলি আছে কি এখনও?

বাঙালি বিদ্বজ্জনদের কাছে  মধ্য কলকাতার সাহেব পাড়াই হয়ে উঠলো ছবির ঠিকানা। উত্তরে  অবশ্য কিছু ছবিঘর ছিলো। যেমন মেছুয়া বাজারে ‘নিউ ইলেকট্রিক থিয়েটার’,  বা অধুনা বিধান সরণির ‘কর্নওয়ালিশ’। যেমন একবার দেখানো হলো ‘সত্যবাদী রাজা হরিশচন্দ্র’। আরেকবার, ৮ রিলের নির্বাক ‘মহাভারত’। কিন্তু এইসব চিত্রমালা গৃহস্থ বাবুদের লঘুপথ্য, শহুরে লোকনাট্য। যারা সিনেমার জাত দর্শক তারা চৌরঙ্গির আশেপাশে, জাদুঘরের কাছাকাছি, আমদানি করা ছবিগুলো দেখতেই পছন্দ করতেন। আর সেই সব ছবিগুলোও কিন্তু ঠিক সময় বুঝে শরৎকালের কাছাকাছি মুক্তি পেতো। কিছু ছবি অবশ্য ক্রিসমাস উপলক্ষে ডিসেম্বরে মুক্তি পেতো। আমাদের সাংস্কৃতিক প্রতিভারা,  যেমন কালিদাস নাগ বা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, কখনও দেশি ছবিতে আগ্রহী ছিলেন না।  কালিদাস নাগ পছন্দ করতেন ‘এম্পায়ার থিয়েটার’, শরদিন্দু যেতেন ‘বিজু’ তে।  পরে যার নাম পাল্টে হয়ে যায় ‘গ্লোব’। শরদিন্দুর সময়ে অবশ্য ‘বিজু’ লিন্ডসে স্ট্রিটে ছিলো না। ছিলো কর্পোরেশন স্ট্রিটে। সম্ভবত ‘রক্সি’তে। কবিরা সিনেমাকে তেমন পাত্তাই দিতেন না। সুধীন্দ্রনাথের ‘সিনেমা’য় আর বিষ্ণু দে র ‘জন্মাষ্টমী’তে ‘জনাকীর্ণ রঙ্গালয়’ বা ‘বিদেশিনী মহাশ্বেতা’র কথা বলা হয়েছে, কিন্তু তারা তেমন সমীহ উদ্রেক করতেন না। শুধু বুদ্ধদেব বসু ছিলেন মেট্রোর উছ্চ্বসিত ভক্ত। ‘তিথিডোর’ উপন্যাসে স্বাতী পল মুনির ছবি দেখতে-দেখতে ভাবে—‘যা দেখছে তা তো ভালোই, যেখানে বসে দেখছে তা-ও ভালো লাগে। মেট্রোর দোতলায় আগে আসেনি সে। এতক্ষণে বুঝলো চেয়ারটা কত আরামের।… এবার থেকে ‘ছবি’  দেখবে অন্ধকারে বসে তো তবে আর ওসব কেন।  কিন্তু ওসবের জন্য স্বাতীকে মানতেই হলো ছবিটা ভালো লাগলো আরও’।

 

লবিতে ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস, মেরলিন ডিয়েট্রিশের ছবি—‘এলিট’, ‘মেট্রো’, ‘গ্লোব’, ‘নিউ এম্পায়ার’ বা ‘লাইট হাউস’য়ে  ছোট কিন্তু পরিচ্ছন্ন পান-পরিসর। তখনও কলকাতার চোখ এত দুঃস্থ হয়ে যায়নি। আমরা আন্তোনিয়োনির ‘ব্লো-আপ’ দেখেছিলাম ‘মেট্রো’তে। ‘এলিট’য়ে দেখেছিলাম ভিসকন্তির ‘আউটসাইডার’। নিউ এম্পায়ারে ছিলো মজা—৭৫ পয়সায় সবচেয়ে কমদামি টিকিটে দৌড়ে চারতলায় ওঠা। সেখানে অলিখিতভাবে স্মোকিং অ্যালাউড। সেখানে বসে ভিসকন্তির ‘ডেট ইন ভেনিস’ দেখতে দেখতে সিগারেট আমরা ঠোঁট-ছাড়া করিনি। এদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত ছিলো ‘টাইগার’।  যা আজ জামাকাপড়ের দোকানে পরিণত হয়েছে। তারাও ক্লোদ লেলুশের নারী-পুরুষ দেখাতো।

অবশ্য যারা শেকলে বাঁধা, যেমন উত্তরা-উজ্জ্বলা-পূরবী বা শ্রী-প্রাচী-ইন্দিরা, সেসব ছবিঘর ছিলো আপামর বাঙালির। সত্যজিৎ রায় দাঁড়িয়ে থাকতেন ভবানীপুরের ‘বিজলি’ সিনেমায়, তাঁর কোনও ছবির উদ্বোধন হয়েছে, শুকনো গাঁদাফুলের নিচে, দর্শকের রিয়্যাকশন জানার জন্যে। ঋত্বিকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ মুক্তি পেয়েছিলো ইন্দিরায়। আর কী আশ্চর্য, দুর্দান্ত হিট।  ‘নায়ক’য়ের মুক্তি উপলক্ষে স্বয়ং নায়ক উত্তমকুমার অবশ্য ইন্দিরাতে ঢুকতে পারলেন না ভক্তদের দাপটে।

তা, এই যে ছবি দেখে কবিরাজি কাটলেট খাওয়া বা দল বেঁধে সিনেমা দেখার মধ্যে একটা সর্বজনীনতা ছিলো। সেই ভিড়, উত্তম-সুচিত্রা, ভানু-জহর, হেমন্ত-সন্ধ্যাকে ভালোবাসতো। আর, কে ছিলো না সেই ভিড়ে!  ছাত্র ও কেরানি, যুগল প্রেমিক, প্রৌঢ় দম্পতি, এমনকি থান পরা বৃদ্ধা। ‘নির্জন সৈকতে’ নাইট শো’তে দেখার পরে রাসবিহারীর নির্জন ট্রাম লাইন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাবা-মার সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসা—মনে হয় সুরভিত স্মৃতি সরণি।

পাড়ার হল—যেমন চেতলার ‘রূপায়ন’ বা কালীঘাটের ‘কালিকা’—মেয়েদের জন্য সাড়ে পাঁচ আনার টিকিট ও ‘পৃথক স্তন্যদানের ব্যবস্থা’ ছিলো।

তারপরে, হিন্দি সিনেমা সরিয়ে দিতে শুরু করলো বাংলা ছবিকে। এক সময়ে ‘বসুশ্রী’তে ‘পথের পাঁচালী’র মুক্তি, ‘অযান্ত্রিক’য়ের মুক্তি—আর সেই উপলক্ষে ঋত্বিক ঘটক পুরনো একটা শেভ্রলে মোটরগাড়িকে ‘বসুশ্রী’র পোর্টিকোর ছাদে সাজিয়ে রেখেছিলেন। সেই হলেই এবার মেঝে ঝনঝন করে ওঠে রফি-র ‘কেয়া হুয়া তেরা ওয়াদা’ গানের পরে ছড়িয়ে দেওয়া সিকি-আধুলিতে। রবিবার মর্নিং শো—বিলিতি ছবি, বাড়ি ফিরে পাঁঠার মাংসের ঝোল, সঙ্গে অর্ধেক আলু। আর এক ধরনের হল ছিলো, যেমন ‘মুনলাইট’ বা ‘তসবীরমহল’—বিস্তর আয়না, কলকা করা নীল-সবুজ নকশা করা দেওয়াল, রিকসা করে নেমে বোরখা পরে কেউ ঢুকে পড়তো। মানতেই হবে যে, আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানের ভেদাভেদই, তাঁবু থেকে হল আর ‘মেট্রো’ থেকে ‘পূরবী’কে আলাদা করেছিলো। হলের ছবি দেখা তবু অনেকটাই যৌথ স্বপ্নলোক। অন্ধকার-স্তব্ধ গর্ভগৃহে যেন মাঝে-মাঝে শ্বাসপ্রশ্বাসের ধ্বনি, একটু ফিসফাস— ‘আহ্ দাদা কী হচ্ছে’? সব মিলিয়ে দেখার অভিজ্ঞতাই যেন যৌন-অভিজ্ঞতা। আর ইন্টারভ্যাল ছিলো রতিবিরতি, চানাচুর ও চিপস—বাথরুমে যাওয়া, পর্দা সরে গেলে স্বপ্নহীন কলকাতা।

দিন-ঋতু-ক্ষণ—থমকে আছে সিনথেটিক আবহাওয়ায়। আজকের মাল্টিপ্লেক্স হয়তো প্রাচুর্যকে সংরক্ষিত রেখেছে, কিন্তু ‘দেখা’কে?  হল ছিলো মনোযোগের জায়গা আর মাল্টিপ্লেক্স সংগঠিত অন্যমনস্কতা।  আসনের নিচে বাতি, আসনের হাতলে পানীয়, আসনে-আসনে জ্বলছে মোবাইল- পর্দা, চঞ্চল দর্শককুল চাপা গুঞ্জনে—এখানে ছায়াছবি গৌণ। ভ্রমণ ও দোকানবিলাসের অন্তর্বর্তী স্তর এই মাল্টিপ্লেক্স। এক ধরনের উইনডো শপিং। অন্দরের ফ্যান্টাসমাগরিয়া। এসকেলটরের ওঠানামায় চলমান অশরীরী। সত্যজিৎ রায়ের অপু আর অপর্ণা এই শপিং  মলে সিনেমা দেখতে আসবে তো?

 

হলের সিনেমা আসলে হরপ্পা বা মেসোপটেমিয়ার মতোই আলাদা সভ্যতা।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


শেয়ার করুন...
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।