করোনাকালে ‘ইমিউনিটি’র বাজার রমরম করছে, বিশ্বজুড়েই হু-হু করে বাড়ছে আয়ুর্বেদের চাহিদা

স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান
আইটিসি-র মতো কোম্পানিও তাদের দুগ্ধজাত প্রোডাক্ট বাজারে বিক্রি করতে বিজ্ঞাপনী প্রচারে বানিয়েছে 'ইমিউনিটি সং'। বিসলারি জল বিক্রি করছে, তা-ও 'ইমিউনিটি বুস্টিং আডেড মিনারেলস' -এর এক নতুন বাহানায়! এমনকি এসেছে ইমিউনিটি বুস্টিং 'হার্ব এন্ড সিড' নামে নতুন রুটিও ! লিখছেন ফিজিওলজিস্ট সোমা বসু।

শেয়ার করুন...
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

করোনা নিয়ে চারদিকে আতঙ্ক! বারমুখো মানুষেরা বাধ্য হয়ে ঘরবন্দি। সব ঘরে মৃত্যুর হানাদারি নেই বটে, তবে সর্বনাশের কিছু বাকি নেই। বাজারে চাকরি নেই আর খাবারের দামে আগুন। শুধু পরিবেশ আর প্রকৃতি নিয়ে হাতেগোনা কয়েকটা ভালো খবর যা রয়েছে।  তবে সব মিলিয়ে যা দেখা যাচ্ছে, ‘নিউ নর্মাল’ জীবনে মানিয়ে নিতে মানুষের আপ্রাণ চেষ্টা। সেই চেষ্টার এক সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে রাতারাতি স্বাস্থ্য ভালো রাখার হাজারো প্রচেষ্টা। আর তাতেই পালে বাতাস লেগেছে অনেক কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্যে। করোনা অতিমারির আবহে ওষুধহীনতায় হিমশিম চিকিৎসককুল যেই না মানুষের ‘ইমিউনিটি প্রসেস’ নিয়ে একটু মুখ খুললেন  বা বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিন আবিষ্কার প্রচেষ্টার নেপথ্যে থাকা ‘ইমিউন সিস্টেম’ নিয়ে দু-একটা  কথা বললেন, অমনি গোটা ভারতে ‘ইমিউনিটি সুপারসাইক্লোন’ বয়ে গেল।

ইন্টারনেটের বিভিন্ন সার্চ সাইটে গিয়ে মানুষ হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলেন ‘হেলদি ফুড প্রোডাক্ট’! ভাবখানা এমন যেন এতদিন যা কিছু খাওয়া হয়েছে, সবই ‘আনহেলদি’! শুধু তাই নয়,  এমন হেলদি ফুড বা ফুড সাপ্লিমেন্ট চাই –- তা  যেন ‘ইমিউনিটি বুস্টার’ হয়।

আরও পড়ুন:  পোস্টমাস্টারনির গল্প-১: “শাশুড়ি স্বাধীন ভারতের প্রথম পোস্ট-মিস্ট্রেস, পরে দায়িত্ব নিলাম আমি”

অনলাইন সংস্থা স্ন্যাপডিল বলছে প্রতি তিনজনের একজন ক্রেতাই ইমিউনিটি বুস্টিং প্রোডাক্ট কিনছে এখন। ভারতের ১৫টি রাজ্যের ৩২টি শহরে করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে  যে, ৯৪ শতাংশ ক্রেতাই এই জাতীয় জিনিস কিনেছেন বা এখনও কিনতে চাইছেন। বিভিন্ন সার্চ সাইটের পরিসংখ্যান বলছে একলাফে ৫০০% বেড়েছে ‘ইমিউনিটি বুস্টিং ফুড প্রোডাক্ট’য়ের সার্চিং। এদের মধ্যে –- ১৫০% ভিটামিন সি, ৩৮০% হার্বস অ্যান্ড মেডিসিনাল ফুড, ৯০% আয়ুর্বেদিক ফুড বা হোম রেমেডি। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে,   ইমিউনিটি সংক্রান্ত তথ্য  এমন ভাবে  ভরিয়ে ফেলা হয়েছে ইন্টারনেটে (বিশেষজ্ঞরা বলেছেন –“ইনফরমেশন ওভারফ্লো অ্যান্ড ওভারলোড”), যাতে  ক্রেতারা সবদিক থেকে ‘আক্রান্ত’ হতে বাধ্য হন।

বলাই বাহুল্য,  আজকের দিনে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী বাজার চলে না, বরং বাজার বাধ্য করে ক্রেতাকে জিনিস কিনতে – পছন্দ করতে। করোনাকালে সে কথা আবারও প্রমাণিত হল। এমনকি অনেক ব্র্যান্ড কোম্পানিও তাদের চালু প্রোডাক্ট-এর সেল নতুন করে বাড়াতে বা সেল ভলিউম ধরে রাখতে  মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিতে ‘ইমিউনিটি বুস্টার লেয়ার’ দিয়েছে  বা নতুন ‘ইমিউনিটি বুস্টার প্রোডাক্ট’ বাজারে ছেড়েছে। আইটিসি-র  মতো কোম্পানিও তাদের দুগ্ধজাত প্রোডাক্ট বাজারে বিক্রি করতে বিজ্ঞাপনী প্রচারে বানিয়েছে ‘ইমিউনিটি সং’। পুরোনো মদ নতুন বোতলে ভরে বেচার মতোই হিন্দুস্থান ইউনিলিভার তাদের হরলিক্সে থাকা ভিটামিন সি, ডি বা জিঙ্ক -এর গুণকীর্তনে   নতুন বিজ্ঞাপনে বলছে এগুলোর ‘ইমিউনিটি বুস্টার’ প্রভাবের কথা। বিসলারি জল বিক্রি করছে, তা-ও ‘ইমিউনিটি বুস্টিং আডেড মিনারেলস’ -এর এক নতুন বাহানায়! এমনকি এসেছে ইমিউনিটি বুস্টিং ‘হার্ব  এন্ড সিড’  নামে নতুন রুটিও ! ভারতের একটি খবরের কাগজের(টাইমস অব ইন্ডিয়ার) রিপোর্টে প্রকাশ : ‘অলিভ অয়েল, সোয়া অয়েল বা ফর্টিফায়েড বিস্কুট ও রুটির এখন চাহিদা তুঙ্গে, কারণ ক্রেতারা মনে করছেন এতে নাকি তাঁদের ইমিউনিটি বাড়বে, যা কোভিড ভাইরাসকে রুখে দেবে!

ফলাফল:  প্রাক করোনা যুগে বিক্রির যে সব পণ্যের  বাজার ছিল ৫ – ১০ শতাংশের মধ্যে , এখন তা বেড়ে ২০-৪০ শতাংশ।

এই ইমিউনিটির ডামাডোলে, ভারতে আয়ুর্বেদিক বাজারও বেড়েছে ১৪ শতাংশ। আমাদের দেশের ক্রেতারা ব্র্যান্ড দেখেই আয়ুর্বেদিক প্রোডাক্ট কেনেন এখন। এই ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে ভারতের বাজারের প্রায় ৮৫ শতাংশ  দখল করে আছে বৈদ্যনাথ, ডাবর আর ইমামি একত্রে। এছাড়াও বাজারে আছে পতঞ্জলি, হিমালয়া ড্রাগ , শাহনাজ, চরক-এর মতো সংস্থাগুলি। ২০২০ সালে প্রকাশিত  ডাবলিনের ‘রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেট’-এর এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ সালে ভারতের ৬৭ শতাংশ মানুষ আয়ুর্বেদিক গৃহস্থালী দ্রব্য ব্যবহার করতেন, যা ২০১৯ সালে বেড়ে হয়েছে ৭৫ শতাংশ।  ২০১৮ সালে যার বাজার মূল্য  ছিল ৩০০ বিলিয়ন ভারতীয় মুদ্রা। তাদের অনুমান, ২০১৯ থেকে ২০২৪ — এই সময়ের মধ্যে এই বাজার মূল্য বেড়ে হতে পারে ৭১০.৮৭ বিলিয়ন ভারতীয় মুদ্রা! অতিমারি, করোনা আর লকডাউন আর আনলকের হাত ধরে বিশ্বজুড়েই হু-হু করে চাহিদা বেড়েছে ভারতীয় আয়ুর্বেদিক প্রোডাক্টের।

প্রকৃতপক্ষে ইমিউন সিস্টেমটা কী বা কী করে তা তৈরি হয় আমাদের দেহে, কীভাবে কখন কাজ করে সে, আদৌ যে সেটা এভাবে রাতারাতি বাড়ানো যায় না — এসব তথ্য যাচাই না করেই বা বলা ভালো না জেনে-বুঝেই ভারতীয়রা ঝাঁপিয়ে পড়লেন ‘কে বা আগে’ কত তাড়াতাড়ি ইমিউনিটি বুস্টার কিনে বাড়ি ফিরতে পারেন, তার প্রতিযোগিতায়। কী জানি বাবা, লকডাউনের বাজারে যদি এমন ভালো প্রোডাক্ট ফুরিয়ে যায়!

 

 


শেয়ার করুন...
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।