‘মাস্ক পরবো না’, এই আন্দোলনই কি ইউরোপে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ডেকে আনলো?

পাঠকের সূত্রে গল্প সংবাদ স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান
সাতকোটির দেশ ফ্রান্সের বড়ো-বড়ো ন’টি শহরে শুরু হল 'নাইট লকডাউন'— রাত ন’টা থেকে ভোর ছ’টা— চলবে আগামী ছয় মাস! দিনের বেলাতেও পুরো নয়, আংশিক খোলা থাকছে শহরগুলো। ইতালিতেও দিনদশেক আগে একদিনেই সংক্রমিত হয়েছেন সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি মানুষ। ফলে রোম-সহ নানা শহরে বন্ধ করা হয়েছে পানশালা, পার্টি। ইউরোপে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে হামবুর্গ থেকে লিখছেন সোমা বসু।

‘নো মাস্ক’ আন্দোলনে বার্লিনের রাস্তা উপচে পড়ল দশ হাজারেরও বেশি লোকের ভিড়ে।

শেয়ার করুন...
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

আমেরিকা, ভারত, ব্রাজিলে এখনো লাগাতার বড়ো রকমের মৃত্যুমিছিল চললেও অনেকটাই সামলে নিয়েছে ইউরোপ। বলা ভালো, সামলে ‘নিয়েছিলো’ ইউরোপ। কিন্তু সেখানে আবার সে ফিরে এসেছে, বিতর্কিত ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ হয়ে। কিন্তু কীভাবে?

করোনা মহামারির শুরুর দিনগুলোতে তথাকথিত প্রথম বিশ্বের ফ্রান্স, ইতালি, স্পেনে যে হারে মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, তাতে ভয় পেয়েছিল গোটা বিশ্ব। সেই সময়ে নোবেল করোনা ভাইরাস সম্বন্ধে জানা ছিল না প্রায় কিছুই। এখনো এই অসুখের বিরুদ্ধে সে অর্থে কোনো  ওষুধ নেই। তবে সংক্ৰমণ যাতে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তার কায়দা-কানুন অনেকটাই জানা।  যেমন,  ন্যূনতম দেড় মিটার শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরা  আর হাত ধোয়া-সহ বেশ কিছু স্বাস্থ্যবিধি পালন করা। আর এইসবই কঠোর ভাবে মেনে বাজিমাত হয়েছিল। মোটামুটিভাবে জুলাই-অগস্ট থেকে দৈনিক সংক্রমণে বেশ খানিকটা লাগাম পরাতে পেরেছিলো ইউরোপ। এরমধ্যে জার্মানির সাফল্য ছিল চোখে পড়ার মতো। সেখানে, মার্চ-এপ্রিলে যেখানে ৬৫০০ জন মানুষ প্রতিদিন নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছিলেন, তা ১২ জুলাই  কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল  দৈনিক ১৩৮ জনে।

আরও পড়ুন:  সোশাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ঝড়, সুজিত বসু’রা কি দেওয়াল লিখন পড়তে পারছেন?

কিন্তু মুশকিল হলো অন্যত্র। সব কিছু বন্ধ থাকলে, দেশে পর্যটকের ভিড় না থাকলে অর্থনীতির চাকা ঘোরে না। পেটের খাবারও জোটে না। এর ব্যতিক্রম নয় ইউরোপও। তাই জার্মানি-সহ ইউরোপের অনেক দেশেই খুলে গিয়েছিল প্রায় সব কিছুই। বেড়ানো থেকে শুরু করে  স্পোর্টস, কনসার্ট— সবকিছুই শুরু হয়েছিলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে। আর, এইভাবেই লন্ডন, প্যারিস, মাদ্রিদ, রোম— ছন্দে ফিরেছিল একটু-একটু করে। যদিও বলাই বাহুল্য, কোনো দেশই কিন্তু করোনা সংক্ৰমণ থেকে মুক্ত ছিল না। শুধু কমেছিল সংক্ৰমণের সংখ্যা এবং তা অনেকটাই। মৃত্যু ছিল হাতেগোনা। যদিও সেইসঙ্গে  ছিল চিকিৎসক-বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা— সংক্রমণের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ নিয়ে। বিশেষ করে শীতের শুরুতে। শীতের পুরো সময়টা জুড়েই সতর্ক থাকার জন্য সাবধান করছিলেন তাঁরা বারংবার।

এদিকে, টানা লকডাউনে ঘরবন্দি একলা জীবনে ডিপ্রেশন, একরাশ মানসিক  ক্লান্তিতে জেরবার মানুষজন  একটু বাইরে বেরিয়ে হাঁফ ছেড়েছিলেন। ইউরোপের লোকেরা ‘সামারে’ ঘরের বাইরে বেশি সময় থাকতে ভালোবাসেন,  সারা বছরের রোদ যতটা পারেন গায়ে মেখে নেন ওই সময়ে। কারণ, ওই সময় অনেকটা সূর্যের আলো পাওয়া যায়। ভিড় বাড়ে সমুদ্রসৈকতে। রক্তশূন্যতায় ভুগতে থাকা  অর্থনীতিকে কিছুটা রক্তের জোগান দিতেই তাই খুলে দেওয়া হলো পর্যটন। ইউরোপের নানা  দেশে ভ্রমণের সুযোগ পেলেন লোকজন। তাঁরা বেড়াতে গেলেন। কিন্তু কে কতটা নিয়ম মানছেন, দেখে-শুনে বোঝা দায় হয়ে দাঁড়ালো! তারপর যা হয় আর কি, শুরু হলো একটু একটু করে নিয়ম না-মানার পালা!  হোটেল-রেস্তোরাঁয় দল বেঁধে যাওয়া, বাড়িতে ‘করোনা  পার্টি’, মাস্ক ব্যবহার না-করা, এইসব বাড়তে লাগলো।

আসলে,  সমাজে সব সময়েই থাকেন কিছু বেপরোয়া মানুষ।  ‘নিয়ম না মানা’ বা নিয়ম মানতে না-চাওয়া লোকজনরা বার্লিন, প্যারিস, লন্ডনে শুরু করলেন আন্দোলন। সেই আন্দোলনে দিন-দিন বাড়তে লাগল ভিড়। ‘মাস্ক পরবো না’ বা ‘নো মাস্ক’-আন্দোলনে বার্লিনের রাস্তা উপচে পড়ল দশ হাজারেরও বেশি লোকের ভিড়ে।

অন্যদিকে, নানা জায়গা ঘুরে, ছুটি কাটিয়ে ঘরে ফিরে এলেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই সেইসব দেশ থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন করোনা। সঙ্গে-সঙ্গে বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা নেওয়া হল। তবুও বাড়তেই লাগল আক্রান্তের সংখ্যা। বিজ্ঞানীরা আবারো সতর্ক করলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসতে চলেছে, শীতের শুরু আর শীতের সময়ে ইউরোপ যেন যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করে’। ইতিমধ্যে  গরম শেষ হয়ে এলো, শীতের শুরু  হলো সেই সব দেশে। আর সেইসঙ্গে  সত্যি হলো আশঙ্কা। আবার, প্রতিদিন নতুন করে বাড়তে লাগলো করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। আর,  সেই সংখ্যাই বাড়তে-বাড়তে আবার সেই বছর শুরুর দিনগুলোতে পৌঁছে গেলো।

এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত ইউরোপ। এমনকি প্রথম আক্রমণের সময় যে সব দেশে আক্রান্তের সংখ্যা কম ছিল, এবারে সেইসব দেশেও আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে তা আশঙ্কাজনক অবস্থাতে পৌঁছে গেছে। সপ্তাহখানেক আগে  সাতকোটির দেশ ফ্রান্সের বড়ো-বড়ো ন’টি শহরে শুরু হল ‘নাইট লকডাউন’—  রাত  ন’টা থেকে ভোর ছ’টা— চলবে আগামী ছয় মাস! দিনের বেলাতেও পুরো নয়, আংশিক খোলা থাকছে  শহরগুলো। ইতালিতেও দিনদশেক আগে একদিনেই সংক্রমিত হয়েছেন সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি মানুষ। ফলে রোম-সহ নানা শহরে বন্ধ করা হয়েছে পানশালা, পার্টি। বন্ধ ফুটবল ম্যাচ। ৩৩ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর ফলে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা যে দেশের, সেই স্পেনের মাদ্রিদেও লকডাউন চলছে এখন। ক্যাটালোনিয়াতেও বেশিরভাগ পাব, রেস্তোয়া আগামী ১৫ দিনের জন্য বন্ধ। জার্মানিতেও  দিনপ্রতি আক্রান্তের সংখ্যা সাত হাজার ছাড়িয়ে ক্রমেই ঊর্ধমুখী, ফলে আবার ফিরে এসেছে কড়াকড়ি।

লন্ডনে ‘নো লকডাউন’ আন্দোলন জোরদার হলেও শেষপর্যন্ত  আংশিক লকডাউন চালু হয়ে গেছে। ছ’জনের বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার বন্ধ। নিয়ম ভাঙলে বিপুল জরিমানা,  এমনকি জেল।

এখন প্রশ্ন হল এই ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ কী?

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বিষয়টা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক আছে।  কেউ-কেউ বলছেন এটা অতটা ভয়ঙ্কর হবে না। আবার একদল বিজ্ঞানী বলছেন, স্প্যানিশ ফ্লুয়ের  বেলায় (১৯১৭ -১৯১৮) এই দ্বিতীয় ঢেউ কিন্তু অনেক ব্যাপক আর নিয়েছিলো আর সেই সঙ্গে তা প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

প্রতিদিন কত সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, সেটা যদি রেখাচিত্র বা গ্রাফের সাহায্যে দেখানো যায় আর সেই চিত্রে যদি দেখা যায় আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমে বাড়তে বাড়তে ক্রমশ বাড়তেই থাকছে,      তবে বিজ্ঞানীরা বলেন এটা একটা ঢেউয়ের মতো, যা কিনা পরে আবার খানিক সরলরেখার মতো আকার নেয়। যেহেতু বিশ্বের অনেক দেশেই করোনার ক্ষেত্রে এই প্যাটার্ন দেখা গিয়েছিল, তাই এবারে আক্রান্তের সখ্য বৃদ্ধিকে ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ বলা হচ্ছে।

এটা হল বেশকিছু ‘সংক্রামক রোগের’ আক্রমণের একটা ‘প্যাটার্ন’ – জনগণের মধ্যে অসুখটা অনেকটা ঢেউয়ের মতো বিস্তৃত হয়। অর্থাৎ  ঢেউয়ের মতো আসে, একটা শীর্ষ বিন্দু বা পিক পয়েন্টে পৌঁছে  আবার চলে যায়। সাধারণত  ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই প্যাটার্ন বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে ফ্লু-জাতীয় অসুখগুলোর ক্ষেত্রে। যেমন, ইনফ্লুয়েঞ্জা। শীতের শুরুতে আক্রমণ করে, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ‘পিকে’ পৌঁছায়, তারপর আবার চলে যায়। পরে আবার নির্দিষ্ট সময়ে  শীতের শুরুতে ফিরে আসে।  অসুখের এই ঢেউয়ের মতো আচরণ নির্ভর করে কী ধরনের  প্যাথোজেন আর তার চরিত্রের নানা বিষয়ের ওপরে। ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রে  যেমন ঋতু।  শীতের সময়ে তাপমাত্রা কমে যায়, কমে সূর্যরশ্মির বিকিরণের মাত্রা, মানুষ বেশি ঘরে থাকে, শীতের জন্য ঘরের দরজা-জানলাও বন্ধ থাকে বেশিরভাগ সময়েই। ফলে সংক্রমণ বাড়ে।

 

যদিও  ইউরোপের এই আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধিই ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ কিনা, তা নিয়ে  বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। অনেকে আবার বলছেন, বেশি সংখ্যক পরীক্ষা হওয়ার কারণে এই সংখ্যা বৃদ্ধি। তাঁদের মতো, মানুষকে বাঁচাতে হলে দিনের-পর-দিন ঘরবন্দি করে রাখলে চলবে না। এইরকম  ‘কনটেনমেন্ট অ্যান্ড রিল্যাক্সেশন’ পদ্ধতির মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। কাজেই এটা দ্বিতীয় ঢেউ নয়।  আবার কিছুদিন নিয়ম মানলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।  এটা অনেকটা পিং-পং খেলার মতো।

তবে অনেকেই  এ তত্ত্ব মানতে নারাজ। জার্মানির হালের মার্টিন লুথার ইউনিভার্সিটির জনৈক এপিডেমিওলজিস্টের মতে, “সংক্রমণ কমেছিল ভাইরাসের চরিত্রের কারণে নয়, মানুষের চরিত্রের কারণে। মানুষ নিয়ম মেনে ছিল বলেই ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া কিছুটা বন্ধ হয়েছিল। সে নিজে থেকে চলে যায়নি”।


শেয়ার করুন...
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।