দুর্গাপুজোয় রয়েছে মাতৃভক্ত বাঙালির অতীত থেকে বর্তমান। তার শেকড় বাকড়ের নাড়ির টান। বৃক্ষ উপাসনা, শষ্য পুজো– হরেক সংস্কৃতি। সাত সমুদ্দুরের জল থেকে বেশ্যাবাড়ির মাটি– কী লাগে না দুর্গাপুজোয়। তাই বলে তাঁর আদি রূপটি ঢেকে যায়নি। তিনি সেই দুর্গতিনাশিনী, দানবদলনী , মহিষমর্দিনী সিংহবাহিনী রণদেবী দুর্গারূপেই পূজিত হচ্ছেন।
দুর্গার নামটি মিলেছে নারায়ণ ও তৈত্তিরীয় আরণ্যক উপনিষদে। আর দেবীর বিস্তারিত বিবরণ মিলেছে মার্কেণ্ডেয় পুরাণের চণ্ডী আখ্যানে। মহাভারতে দুর্গা কংস ধ্বংসকারী এক কুমারী যোদ্ধাদেবী। ইনি মদ্যমাংস প্রিয়া। ঋকবেদে ননা বা নানা নামে এক দেবীর সন্ধান মেলে। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতে, কুষাণযুগের মুদ্রায় খোদিত যে সিংহবাহনা চতুর্ভূজা দেবী, তিনিই ননা বা নানা। এই দেবীর সঙ্গে মিল রয়েছে এশিয়া মাইনরের দেবী ইস্তারা বা প্রাচীন পারস্যদেশের অনহিত বা অনাহিত দেবীর সঙ্গে। দেবীপুরাণ ভবিষ্যপুরাণ বৃহনান্দিকিশোর প্রভৃতি গ্রন্থে দুর্গাপুজোকে অশ্বমেধযজ্ঞ তুল্য বললেও কখন যে দেবীর পুজো হত তা নিয়ে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। শুধু শরৎ বা বসন্তকাল নয়, বরং বছরের বিভিন্ন সময়ে এই যুদ্ধদেবীর পুজো হতো বিভিন্ন নামে। এর উত্তরাধিকার আজও বহমান বর্ধমানের বিভিন্ন জনপদে। এই পুজোগুলির সঙ্গে শারদীয়া দুর্গোৎসবের কোনো যোগ নেই। এবার সে কথায় আসছি।
কাটোয়া থানার কালিকাপুরে পূজিত হচ্ছে অষ্টভুজা মহিষাসুরমর্দিনী সিংহবাহিনী দুর্গার অপরূপ প্রস্তরভাস্কর্য কালীরূপে। পাল-সেন যুগের মূর্তি। কালো পাথরে খোদিত। উচ্চতা চার ফুট। চওড়া গড়ে ছাব্বিশ ইঞ্চি। চালির শীর্ষে সুগঠিত কীর্তিমুখ। তার নিচে নভোবিহারী বিদ্যাধর বিদ্যাধরী। দেবী ত্রি-নয়না। মাথায় কিরীটমুকুট। অনন্ত যৌবনা। মুখখানি অপূর্ব সৌন্দর্য ও সুষমামণ্ডিত। ডান পা মহিষের পিঠে। বাম পা দ্বিদল প্রস্ফূটিত পদ্মের উপর। নানা অলংকারে সুসজ্জিত। পরনে শাড়ি। সুগোল স্তনদ্বয় স্বল্পবাস কাঁচুলি বন্ধনে আবদ্ধ। ডান হাতে তলোয়ার, পূর্ণথলি থেকে শর উৎক্ষেপণরত, সুদর্শনচক্র এবং মহিষাসুরের বক্ষ বিদীর্ণকারী ত্রিশূল। বাম হাতগুলিতে ঢাল, কুঠার, ধনুক ও মহিষাসুরের চুলের মুষ্টিবদ্ধ হাত। দেবীর দুই পাশে ঢাল তলোয়ার হাতে জয়া-বিজয়া অথবা ডাকিনী-যোগিনী। খড়্গ হস্তে মহিষাসুর। গালে চাপ দাড়ি। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। পাদপীঠে দেবীপূজক মার্কেণ্ডেয় মুনি ও জনৈক ঋষি।
দেড়শতাধিক বৎসর পূর্বে কৌমারী নদী গর্ভ থেকে পাওয়া গিয়েছিল মূর্তিটি। কৌমারী নদী আজ বিলে বিলীয়মান। লোকমুখে যার নাম কুমরির বিল। কুমরি নামে একটি জনপদও গড়ে উঠেছে। সপ্তমাতৃকার অন্যতম কৌমারীদেবীরূপে দুর্গামূর্তিটি পূজিত হতো একসময়। পৌষসংক্রান্তিতে দেবীর উদ্দেশে কুমরির বিলে পুজো হয়। বর্তমানে কুমরি থেকে প্রায় সাত কিমি দূরে কালিকাপুর গ্রামে দেবী কালিকারূপে নিত্য পূজিত হচ্ছেন।
অনেকেই বলেন দুর্গা হলেন দুর্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কেউ বলেছেন নগরপালিকা দেবী। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে দুর্গের মধ্যে যে সব দেবীর পুজোর কথা বলেছেন তাদের মধ্যে অপরাজিতা বা দুর্গা অন্যতম। সন্দেহ নেই; প্রাচীনকাল থেকেই দুর্গার সঙ্গে রাজতন্ত্রের ঘনিষ্ঠ যোগ তৈরি হয়েছিল যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য। বর্ধমান রাজবংশের উত্থানের বহু পূর্ব থেকেই পাটুলি রাজবংশ ৭২টি পরগনা জুড়ে দক্ষিণবঙ্গে তাদের সাম্রাজ্যবিস্তার করেছিলেন। এই রাজবংশে তিনটি ব্যতিক্রমী মহিষমর্দিনী দুর্গার প্রস্তরমূর্তি রয়েছে। পাটুলি থেকে নিয়ে গিয়ে তা বর্তমানে শেওড়াফুলির নিস্তারিণী কালীমন্দিরে পূজিত হচ্ছে। তিনটির মধ্যে একটি অষ্টাদশভুজা মহিষমর্দিনী দুর্গা। উচ্চতা প্রায় দু’ফুট। বামনপুরাণে বলা হয়েছে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে হত্যা করার সময় অষ্টাদশভুজা হয়েছিলেন। এই মূর্তির অভিনব গঠনশৈলীর সঙ্গে কালিকাপুরের দেবীর বিশেষ সাদৃশ্য দেখা যায়।
বর্ধমানের দক্ষিণ থেকে উত্তর অংশের বিস্তৃত ভূভাগের জনপদগুলিতে মাতৃপুজোর আধিক্য লক্ষ করার মতো। যোগাদ্যা, তারা, চামুণ্ডা, ত্রৈলোক্যতারিণী, সিদ্ধেশ্বরী, গন্ধেশ্বরী, সর্বমঙ্গলা আর জয়দুর্গারূপে মহিষমর্দিনী পূজিত হন। অধিকাংশ সেবাইত উগ্রক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের। বিশেষ করে জয়দুর্গা পুজো হয় কলিগ্রাম শুনুর আমারুণ রায়না মির্জাপুর প্রভৃতি গ্রামে। মূর্তি বলতে মহিষাসুরমর্দিনী সিংহবাহিনী দুর্গা। পুজো হয় বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ বা আষাঢ় মাসে। এই সব গ্রামে মৃন্ময়ী দুর্গা আনা নিষিদ্ধ। কলিগ্রামে জয়দুর্গা মূর্তি মানে প্রায় চার ফুট উচ্চতার অষ্টভুজা মহিষমর্দিনী দুর্গামূর্তি। এই মূর্তির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এখানে মহিষাসুর মূর্তি নেই। পরিবর্তে দেবী মহিষকে শূলবিদ্ধ করেছেন। পাল-সেন আমলের মূর্তি। পুজো হয় রথযাত্রার চোদ্দদিন পরে অনুষ্ঠিত অশূন্যশয়না দ্বিতীয়া তিথিতে।পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দেবীর বিয়ে হয় পার্শ্ববর্তী গ্রামের জনৈক যুবকের সঙ্গে। এই দেবীপুজোয় অতীতে নরবলি হতো।
অখণ্ড বর্ধমান জেলার লৌকিক দেবদেবীর মধ্যে চণ্ডীর স্থান সর্বাগ্রে। অধিকাংশ গ্রামের গ্রাম্যদেবী চণ্ডী। ক্ষেত্রসমীক্ষায় জানা গেছে – কাটোয়া মহকুমায় প্রায় সাড়ে তিনশো গ্রামের মধ্যে পঞ্চাশটির অধিক গ্রামের গ্রাম্যদেবী এই চণ্ডী। গ্রামনাম অনুসারেই তাঁর পরিচিতি। যেমন পাতাইচণ্ডী, কুলাইচণ্ডী, সাঁকতাইচণ্ডী, বোঁয়াইচণ্ডী, গৌরচণ্ডী, মালুনচণ্ডী, ভাল্যচণ্ডী, বাঘরাইচণ্ডী, মউচণ্ডী ইত্যাদি। এই সমস্ত চণ্ডীর পুজো শরৎকালে দেবী দুর্গার সঙ্গে হয় না। এদের পুজো হয় বেশির ভাগ আষাঢ় নবমী তিথি বা বছরের অন্য কোনো সময়ে। তবে মূর্তিগুলি মূলত মহিষাসুরমর্দিনী সিংহবাহিনী দুর্গা। অরক্ষিত স্থানে বা গাছতলায় পড়ে থাকার জন্য অধিকাংশ মূর্তি চুরি হয়ে হয়ে গেছে।
কাটোয়ার কাছে সুড্ডো গ্রামে ছিল সুরুরাচণ্ডী দুর্গামূর্তি কিম্বা বাঘডোনা গ্রামে ছিল বাঘাইচণ্ডীর দুর্গামূর্তি। সিংহবাহিনী দেবীর নামে একটি গ্রাম রয়েছে মঙ্গলকোটের সিঙ্গটগ্রাম। এই গ্রামের অধিশ্বরী সিংহবাহিনীর পুজো হলেও মূর্তিটি চুরি হয়ে গেছে। কেতুগ্রামের মউগ্রামের অধিশ্বরী মধুমতী বা মউচণ্ডী। এক ফুট উচ্চতার অসাধারণ এক মহিষমর্দিনী সিংহবাহিনী দুর্গামূর্তি। ভট্টাচার্য গোষ্ঠীরা সেবাইত। দুটি মূর্তি রয়েছে। তবে নবীন মূর্তিটি অসাধারণ। টেরাকোটা মন্দিরে খোদিত দুর্গা ফলকের মতো এই মূর্তিটি। আনুমানিক অষ্টাদশ শতকের বলেই মনে হয়। নিত্যপুজো ছাড়াও দেবীর দু’বার পুজো হয়; নবান্ন উৎসবে আর বিজয়াদশমীতে দুর্গার ঘট বিসর্জনের পর।