সম্পাদক লেখা দিতে বলেছেন, বিষয় ‘বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ’

স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান
আচ্ছা বলুন তো, ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসের ছ’তারিখের আগে কোনো দেশে কোনো স্কুলের ছাত্রকে বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ বিষয়ে রচনা লিখতে হত কি?... ছোটদের মতো করে বড়দের প্রশ্ন করলেন গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়।

শেয়ার করুন...
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়: এই শিরোনামে রচনা প্রথম কবে লিখতে হয়েছিল খেয়াল নেই, তবে যতদূর মনে আছে তখন হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে যেতাম। বিভিন্ন ক্লাসে পরীক্ষাতে সম্ভবত একাধিকবার লিখতে হয়েছিল। তারপর একসময় স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে গেলাম, কোনো রচনা লেখার আর প্রয়োজন হয়নি। কাজেই বেচারি ইউরেনিয়া নিঃশ্বাস ছেড়ে বেঁচেছিলেন। তখন কি আর তিনি ভেবেছিলেন যে বিচারকের হাতুড়ি নিয়ে ‘আবার সে আসিবে ফিরিয়া’?

ইউরেনিয়া কে? প্রাচীন গ্রিকরা সমস্ত সাহিত্য শিল্পকলা ইত্যাদির প্রেরণাদাত্রী হিসাবে মোট নয়জন মিউজ বা দেবীকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁরা সবাই দেবরাজ জিউস ও স্মৃতিশক্তির দেবী নিমোজিনির সন্তান। অবশ্য তারও আগে তাঁদের আকাশের দেবতা ইউরেনাস ও পৃথিবীর দেবী গাইয়ার সন্তান মনে করা হত। তাহলে তাঁরা সম্পর্কে হবেন জিউসের পিসি এবং নিমোজিনির বোন। খুবই জটিল সম্পর্ক! যাকগে, মোদ্দা কথা হল ইউরেনিয়া হলেন জ্যোতির্বিদ্যার মিউজ।

আরও পড়ুন:  হায় সেই মায়া ঝরা সন্ধ্যা

প্রাচীন ভারত বিদ্যার সমস্ত দায়িত্ব দেবী সরস্বতীর হাতে তুলে দিয়েছিল, কিন্তু মিউজদের সঙ্গে আধুনিক যুগের বিশেষজ্ঞদের মিল পাওয়া যাবে। শুধু কবিতার জন্যই চারজন আলাদা আলাদা মিউজ ছিলেন। মহাকাব্য লেখাতে যিনি প্রেরণা দিতেন, গীতিকবিতা তাঁর ডিপার্টমেন্ট ছিল না, আবার প্রেমের কবিতার দায়িত্ব নিয়েছিলেন অন্য একজন। নাটকের ক্ষেত্রে ট্রাজেডি আর কমেডি আলাদা আলাদা জায়গা থেকে অনুপ্রেরণা পেত। মিউজদের তালিকায় বিজ্ঞানের একটা শাখারই নাম ছিল, তা হল জ্যোতির্বিদ্যা। ইউরেনিয়ার হাতে থাকত গ্লোব আর কম্পাস। কম্পাস মানে দিকনির্দেশক চুম্বক নয়। প্রাচীন গ্রিকরা সেটা উদ্ভাবন করে উঠতে পারেনি, সেই বানিয়েছি চিনারা। এটা হল কাঁটা কম্পাস, সেটা ছোটবেলায় আমার জ্যামিতি বাক্সে থাকত।

কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন শুধু জ্যোতির্বিদ্যার দেবীকেই সব বিজ্ঞানের দায়িত্ব দিলাম কেন? তার কারণ আর কিছু নয়, সায়েন্স শব্দটা প্রাচীন হলেও আমরা যে অর্থে এটাকে ব্যবহার করি তা নিতান্তই আধুনিক, অষ্টাদশ শতকের আগে এই মানেটা চলত না। আর জ্যোতির্বিদ্যা শুধু প্রথম আধুনিক অর্থে বিজ্ঞান নয়, বহুদিন পর্যন্ত ছিল একমাত্র বিজ্ঞান। গ্রহ নক্ষত্রের নিয়ম মাফিক চলাফেরা, তাদের পরিবর্তনহীনতা মানুষকে একটু মানসিক স্বস্তি দিত। সমস্ত প্রাচীন সভ্যতাই তাই আকাশে স্বর্গকে খুঁজে পেয়েছিল, মৃত্যুর পরে মানুষের সেখানেই স্থান হত।

মজাটা হল ইউরেনিয়াও পরবর্তীকালে কবিতার দায়িত্ব পেয়েছিলেন, তখন অবশ্য গ্রিক সভ্যতা অস্তাচলে। মধ্যযুগে ইউরোপে বিজ্ঞান গবেষণা শুধুমাত্র প্রাচীন পণ্ডিতদের পুঁথি পড়ে তাদের টীকা ভাষ্য রচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ইউরেনিয়া মনে হয় বেকার হয়ে পড়েছিলেন, তাই খ্রিস্টধর্মের তত্ত্ব নিয়ে কবিতার প্রেরণা জোগানোর কাজটা তখন তাঁর ঘাড়ে পড়েছিল। এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের লেখালেখি পড়ে মনে হয় দায়িত্বটা বেশ কঠিন ছিল, ভদ্রমহিলা ঠিক পেরে ওঠেন নি।

এই দেখুন। লিখতে বসেছিলাম বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ, চলে গেলাম ইউরেনিয়ার গল্পে। আচ্ছা বলুন তো, ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসের ছ’তারিখের আগে কোনো দেশে কোনো স্কুলের ছাত্রকে বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ বিষয়ে রচনা লিখতে হত কি? বিজ্ঞান আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবে জেনে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছিলাম; ইউরেনিয়া সমেত সব মিউজকে ছুটি দিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর তো শুধু অ্যাটম বোমা নয়, এলো রেডিয়েশন আর পেস্টিসাইড পয়জনিং, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, এরকম কত কী! ছোটবেলায় এসব যদি জানা থাকত!

অভিশাপ আর আশীর্বাদের মধ্যে তফাত করাটা সবসময় সহজ নয়। রচনাতে লিখতাম প্রয়োগ কিভাবে করা হবে তার উপর নির্ভর করছে বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ — নিউক্লিয়ার বোমা খারাপ, কিন্তু রেডিওথেরাপি, এমআরআই ভালো। এবার ইতিহাস বই খুলুন। দেখবেন চাষবাস শুরুর আগে মানুষ ছিল যাযাবর, কুড়িয়ে বাড়িয়ে আর শিকার করে যা জুটত, তাই খেত। কৃষিকাজ আবিষ্কার হল মানুষের ইতিহাসে দ্বিতীয় বিপ্লব, এর ফলে গ্রাম ও নগর তৈরি সম্ভব হয়েছে, সভ্যতার অগ্রগতি হয়েছে। তাহলে কৃষি আবিষ্কার নিশ্চয় বিজ্ঞানের আশীর্বাদ। জানেন কি চাষবাস শুরু করার আগে মানুষের গড় আয়ু ছিল তেত্রিশ বছর। বারো হাজার বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যে কৃষি আবিষ্কার হয়, তার পরে সেই গড়টা কমে দাঁড়িয়েছিল পঁচিশ বছর? যাযাবররা মাটির সঙ্গে বাঁধা থাকত না, এক জায়গায় খাবার শেষ হয়ে গেলে অন্য জায়গায় চলে যেত, তাদের স্বাস্থ্য ছিল অনেক ভালো, দুর্ভিক্ষ বা মহামারী কাকে বলে জানত না। তাহলে মানুষ কৃষি বেছে নিয়েছিল কেন? খুব সহজ, সংখ্যাধিক্য। এমনি এমনি তো প্রাচীন মিশরের দেবী হেকেট একই সঙ্গে নীল নদে বন্যা, কৃষি এবং প্রজননশক্তির দায়িত্ব পাননি? যাযাবর মানুষের থেকে এক জায়গায় থিতু মানুষের সন্তানসংখ্যা সব সময়েই বেশি হবে। তাই ডারউইনের সূত্র মেনে কৃষিকাজই প্রজাতির বিকাশের পক্ষে যোগ্যতর। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে আবার তেত্রিশ বছর ছুঁল সবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। তাহলে কৃষি আবিষ্কার কি বারো হাজার বছরব্যাপী অভিশাপ?

পুরানো কথা অনেক হল, এবার সামনের দিকে তাকানো যাক। এই করোনার যুগে একটা কথা খুব শোনা যাচ্ছে। এআই অর্থাৎ আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্স। আপনি যখন গুগলকে কোনো কিছু খুঁজতে বলেন, কর্টানা অ্যালেক্সা বা সিরিকে নিজের রুটিন ঠিক করার দায়িত্ব দেন, ওলা বা উবের জাতীয় অ্যাপক্যাবের শরণাপন্ন হন, তখন আপনি এআই-এর সাহায্য চাইছেন। এআই–এর একটা বড় সুবিধা হল খুব দ্রুত বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষমতা — করোনার ওষুধ বা ভ্যাকসিনের জন্য অনেক বিজ্ঞানী তাই তার উপর নির্ভর করছেন। গুগল সার্চে ঠাণ্ডা লাগা, মাথা ধরা, জ্বর ইত্যাদি কতবার খোঁজা হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করে গুগল ফ্লু ট্রেন্ডস অ্যালগরিদম ব্রিটেনের জাতীয় হেলথ সার্ভিসের দশদিন আগে ফ্লু এপিডেমিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে কিনা বলতে পারে, স্বাস্থ্য দপ্তর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। পাশাপাশি আপনার ই-মেল, মেসেজ, গত কদিনে কোন শব্দটা বেশি খুঁজেছেন, কোন ধরনের খবর পড়েছেন, এসব দেখে আপনি কোন জিনিসটা কিনতে পারেন থেকে শুরু করে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেবেন কিনা সবই অনুমান করতে পারে এআই। অরওয়েলের নাইন্টিন এইটিফোর বাস্তবে নেমে আসবে না? গল্পকথা নয়, ব্রেক্সিটের গণভোট বা গত মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এআই-এর সাহায্যে ফেসবুক প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে আলাদা আলাদা ব্যক্তির জন্য আলাদা আলাদা পদ্ধতিতে প্রচার চালানো হয়েছিল। আবার বলি, স্কুলের রচনাতে লিখতাম এ হল বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগ। কিন্তু ঠিক কোনখানে দাঁড়িটা টানব? আগে অটোমেশনের জন্য চাকরি যাওয়ার কথা শুনলে বলতাম অন্তত বুদ্ধির কাজ তো যন্ত্র করতে পারবে না। এখন? ডাক্তার উকিল শিক্ষক, এমনকি লেখক সঙ্গীতকার সবাই যদি সমাজে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে?

তেমনি আর এক নতুন প্রযুক্তি হল জেনেটিল ইঞ্জিনিয়ারিং। কিছু শিশু জন্মগত শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্মায়, তাদের এবং তাদের বাবা মা পরিবারের অবস্থাটা আমরা কিছুটা অনুমান করতে পারি। বিজ্ঞান আমাদের মুক্তির উপায় দেখাচ্ছে — জিন টেলরিং। অনেক সময়েই এই ত্রুটিগুলো জেনেটিক, সংশ্লিষ্ট জিনটা পাল্টে দাও। মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীতে হয়েছে, মানুষের ক্ষেত্রেও দু’বছর আগে চিনে এক বিজ্ঞানী সে কাজ করেছিলেন। নিশ্চয় আমরা চাইব জন্মগত ত্রুটি দূর করতে, কিন্তু ঠিক কোথায় থামব? সন্তানের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে চাওয়াটা কি অন্যায়? তার রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ানো? পেশীর শক্তি বৃদ্ধি, হাড় মজবুত করা? দৃষ্টিশক্তি বাড়ানো? বুদ্ধিবৃত্তি? এই সুপারম্যান বা সুপারওম্যানদের সন্তানরাও তাদের বাবামাদের ক্ষমতা নিয়ে জন্মাবে। শাসকরা চিরকালই শাসিতদের থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখতে চেয়েছে, কিন্তু বাস্তবে দু’দলের জিনে কোনো পার্থক্য ছিল না। এখন? বিজ্ঞান তাহলে কি কিছু লোকের জন্য আশীর্বাদ আর বাকিদের জন্য অভিশাপ?

শেষ করতে হবে, সুতরাং এখানেই থামা যাক। সত্যি সত্যি কি আর ইউরেনিয়া বলে কেউ আছেন যিনি আমার রচনাটা পড়বেন?  হাসালেন, এখন কেউ আর ইউরেনিয়াকে বিশ্বাস করে নাকি? কিন্তু দুহাজার বছর আগে তো করত; সুতরাং সমাজবিদ্যার আধুনিকতম এক তত্ত্ব অনুযায়ী সে যুগে তাঁর অস্তিত্ব ছিল। ভাগ্যিস আমি দু’হাজার বছর আগে লেখাটা লিখতে বসিনি; এইরকম উদ্দেশ্যহীন লেখা পড়লে তিনি নির্ঘাত আমাকে অভিশাপ দিতেন।

 

 


শেয়ার করুন...
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

1 thought on “সম্পাদক লেখা দিতে বলেছেন, বিষয় ‘বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।